সাহিত্যের দুটি ধারা- লিখিত সাহিত্য ও মৌখিক সাহিত্য। যে জাতির ভাষা আছে, ভাষার বর্ণমালা ও লিপি আছে, সে জাতির পক্ষে লিখিত সাহিত্য রচনা করা সম্ভব হয়েছে। যে জাতির ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণমালা ও লিপি নেই, সে জাতির পক্ষে লিখিত সাহিত্য রচনা করা সম্ভব হয় নি। পৃথিবীতে এখনও অনেক জাতি আছে, যাদের ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণমালা ও লিপি নেই; তারা এখনও মৌখিক ধারার সাহিত্য অনুসরণ করে চলেছে। বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের আদিবাসী বা উপজাতির মধ্যে এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত আছে। নিজের আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা ও উপলব্ধিকে প্রকাশ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই অপ্রতিরুদ্ধ প্রবৃত্তির তাড়নায় লিখিত হোক, মৌখিক হোক মানুষ আপন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেছে। সাহিত্য সৃজনশীল মানুষের অর্থবহ এই প্রকাশ-বেদনার ফল। মানুষ আগে ভাষা আয়ত্ত করেছে, পরে বর্ণমালা ও লিপি আবিষ্কার করেছে। এর সূত্র ধরে বলা যায়, মৌখিক ধারার লোকসাহিত্য আগে রচিত হয়েছে, লিখিত সাহিত্য রচিত হয়েছে অনেক পরে। শিক্ষার সাথে লিখিত সাহিত্যের সম্পর্ক আছে। শিক্ষিত মানুষ নিজস্ব আবেগ, কল্পনা ও চিন্তার ফসলকে ভাষায় প্রকাশ ও বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। লোকসাহিত্য একটি সংহত সমাজের সাধারণ মানুষের সমষ্টিগত মানস-ফসল। তারা স্বল্প শিক্ষিত অথবা একেবারেই শিক্ষা ও বর্ণজ্ঞানহীন। কিন্তু তাদের আবেগ, কল্পনা ও চিন্তাশক্তি আছে, প্রকাশের তাড়না ও সৃষ্টির আনন্দ আছে। তারা তাদের আবেগ-অনুভূতির কথা মুখে মুখে ব্যক্ত করে মানুষকে শুনিয়েছে। গান-গাথা গেয়ে, কথা- কাহিনী বলে, ছড়া-বোল আবৃত্তি করে, ধাঁধা প্রশ্ন করে নানা প্রক্রিয়ায় আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজেছে। তারা যুগ যুগ ধরে লোকসাহিত্য রচনা করেছে এবং স্মৃতি ও শ্রুতির মধ্যে ধারণ ও লালন করে একে বাঁচিয়ে রেখেছে। লোকসাহিত্য বৃহত্তর অর্থে লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। প্রকাশ মাধ্যম ভাষা হওয়ায় শিল্পসমৃদ্ধ এ শাখাটি অনেক বেশি লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে।