ফ্ল্যাপে লিখা কথা কেন পাহাড়ে চড়েন? এ প্রশ্নটি একজন পর্বতারোহীকে জীবনে সবচেয়ে বেশিবার শুনতে হয়। বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্বতারোহী, দুর্দমনীয় এড ভিশ্চার্স এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আঠারো বছরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ১৪ টি পর্বতে অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করে।
একজন তরুণ অদম্য মানসিক শক্তি ও অমানুষিক পরিশ্রমে তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য। পর্বতের নেশায় পথু চিকিৎসকের ইচ্ছেমতো ত্যাগ করে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেছেন, যাতে ইচ্ছেমতো পাহাড়ে যেতে পারেন। সারাজীবন তিনি সেসব কাজই করেছেন, যা তাঁকে পাহাড়ে চড়তে সাহায্য করবে।
এড ভিশ্চার্স নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন না, বরং মনে করেন তিনি ‘ঝুঁকি সমন্বয়ক’। তাঁর মতে, এই আঠারো বছরের সংকল্প সফল হয়েছে নিরলস প্রস্তুতি এবং ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তের জন্য।
প্রথমবার এভারেস্টের মাত্র তিনশো ফুট নিচ থেকেই নেমে আসতে হয় এড ভিশ্চার্সকে। এরপর তিনবারের চেষ্টায় দেখেন মূল চূড়া আর মাত্র বিশ ফুট উচ্চতায়, যা একা পার হওয়া ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ আট বছর পর তিনি ফিরে এসে সেই বিশ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করেন। তবে এড সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন অন্নপূর্ণা পর্বতে। বারবার এই পর্বতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর তিনি সবশেষে ২০০৫ সালে সবচেয়ে দুর্গম এবং প্রাণ হরণকারী অন্নপূর্ণার চূড়ায় উঠে স্বপ্নকে সত্যি করেন। এড ভিশ্চার্স মনে করেন, ‘পর্বতকে কখনো জয় করা যায় না, তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়। পর্বত থেকে শেখা ধৈর্য কাজে লাগাতে পারলে সে তাকে আরোহণের অনুমতি দেয়। জীবনের অনেক আরাধ্য ব্যাপারই আসলে এরকম’।
শুনলে অবাক লাগবে যে, এড ভিশ্চার্স তিরিশ বার ৮০০০ মিটার উচ্চতার পর্বত অভিযানে গিয়ে দশবার আরোহণ বিপজ্জনক মনে করে নেমে এসেছেন। ১৯৯৬ সালের ১০ মে এভারেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্য ঘটে। সেদিন চূড়ায় যাওয়ার কথা থাকলেও ৯ তারিখে পরিস্থিতি ভালো না মনে হওয়ায় তিনি নেমে আসেন। পরদিন ওপরে মারা যান তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রব হল, স্টক ফিশারসহ ১২ জন পর্বতারোহী।
এড ভিশ্চার্স পৃথিবীর সেই বিরল মানুষদের একজন,যিনি শক্ত গলায় বলতে পারেন, ‘ ‘আমার জীবনের সবকটি স্বপ্ন সত্যি হয়েছে’। পর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ বইটি আপনাকে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে।
লেখক পরিচিতি আমার চেনা বাংলার এক বিরল তরুণ সজল খালেদ। বহু কাজে তিনি হাত দিয়েছেন, মেলা কাদামাটি তিনি গায়ে মেখেছেন। এক সময় তিনি ম্যারাথন পরিচালনা করেছেন, অন্য সময় ডকুমেন্টারি ছবি বানিয়েছেন। এবার তিনি পরিচিতি পেয়েছেন আলোচিত এক কিশোর-চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। নানা বিষয়ে কৌতূহলী তিনি। তার উপলব্ধির গন্ডিটাও তাই এই সমতট পেরিয়ে গিয়ে পর্বত ছুঁয়েছে। নবীন বাংলাদেশের হিমালয় অভিসারে তিনি আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, এখনও আছেন। পর্বত নিয়ে পড়াশোনাটা তার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও লেখালেখি এই প্রথম। প্রথম হলেও অনুবাদের কাজে এই বইটিতে তিনি এক উত্তুঙ্গ শিখর স্পর্শ করেছেন বলেই আমি মনে করি। এই সাফল্যের পিছনে হয়তো কাজ করেছে ভারত ও জার্মানিতে ভিন-ভাষায় লেখাপড়া ও পর-সমাজে বড় হওয়ার অভিষবণ এবং হিমালয়ে তার আত্মসন্নিধান।
ইনাম আল হক অভিযাত্রী, পাখিপ্রেমী
ভূমিকা লাটভিয়ান ও জার্মান পিতামাতার ঘরে ১৯৫৯ সালের ২২ জুলাই আমেরিকার ফোর্ট ওয়েইন, ইন্ডিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন এডমান্ড ভিস্টার্স (Edmund Viesturs)। এড ভিশ্চার্স নামেই তিনি বেশি পরিচিত।
১৮ বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় বিখ্যাত আমেরিকান পর্বতারোহী এড ভিস্টার্স জয় করেছেন মাউন্ট এভারেস্টসহ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ১৪টি দুর্গম পর্বতচূড়া। অল্পবয়স থেকেই নিষ্ঠা ও ধৈর্যের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেছেন তিনি নিজেকে জীবনের এই একটিমাত্র লক্ষ্য অর্জন করবেন বলে। তিনিই প্রথম মার্কিন মাউন্টেনিয়ার, যিনি এভারেস্টের শৃঙ্গে আরোহণ করেছেন একবার নয়, সাত-সাতবার। এ ছাড়াও তিনি অন্নপূর্ণা, কে-টু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধবলগিরি, মাকালু, নাঙ্গাপর্বতের মত ৮০০০ মিটারের বেশি উঁচু সবকটি পর্বতচূড়ায় আরোহণ করেছেন, এবং রেকর্ড গড়েছেন একটিতেও অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার না করে। তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা চমৎকার প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন তিনি এই বইয়ে।
বইটির ঝরঝরে, সাবলীল অনুবাদ করে আমার মত অসংখ্য ঘরকুনো বাঙালীর মস্ত উপকার করেছেন বাঙালী পর্বতারোহী সজল খালেদ। এজন্য প্রশংসা তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। শুধু আশা করছি তা নয়, আমার বিশ্বাস: প্রতিটি দুঃসাহসী, অভিযানপ্রিয় বাঙালীর অন্তর স্পর্শ করবে এ-বই, তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে যার যার নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধ্যসাধনের প্রয়াসে।
অনুবাদক নিজেও একজন পর্বতোৎসাহী ও ফিল্ম মেকার। তাই এইসব দুঃসাহসিক অভিযানের খুঁটিনাটি সবকিছু সহজ ও সুন্দরভাবে দরদের সাথে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বইটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক বসায় গড় গড় করে পড়ে শেষ করা যায়।
প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মধ্যে দুর্জয়, দুরারোহ পর্বতের প্রতি স্বভাবজাত দুর্বার আগ্রহ ও আকর্ষণ রয়েছে। ওই উঁচু-উঁচু পর্বতের মাথায় পা রেখে দাঁড়িয়ে নিজের মানবসত্তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা কল্পনা করলেই আমাদের বুকে শিহরন জাগে। কিন্তু বাস্তবে যাঁরা সেখানে যান তাঁদের কতটা অধ্যবসায়ের সঙ্গে নিজেকে কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তুলতে হয়, শারীরিক ফিটনেসের জন্য কেমন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, অদম্য সঙ্কল্প নিয়ে কীভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় করে বিপদের মুখে ঝাঁপ দিতে হয় সেসব বর্ণনা রয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। দুঃসাধ্য এই কাজে প্রয়োজনে একে অপরকে নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করতে হয়, সবসময় অন্যান্য অভিযাত্রীদের প্রতি বাড়িয়ে রাখতে হয় সাহায্যের হাত।
আত্মজীবনীমূলক এই রচনায় বাঙালী পাঠকের প্রায়-অপরিচিত একটা জগতের স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে, যা ছোট-বড় সবার মন টানবে। বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়: যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। তবে কেবলই বিপদ, ভয় আর মৃত্যুর ঝুঁকির কাটখোট্টা বর্ণনা নয় এ বই, স্থানে স্থানে রসালো কিছুও আছে।
একবার কে-টু (দ্বিতীয় উচ্চতম) পর্বতের চূড়ায় প্রায়-পৌঁছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছিল ভিশ্চার্স ও তাঁর বন্ধু স্কট ফিশারকে, দুজন বিপদগ্রস্ত পর্বতারোহীকে নীচের ক্যাম্পে নামতে সাহায্য করার ডাক পেয়ে। তারপর আবার যখন উপরে উঠছেন, টের পেলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষার ধস শুরু হতে চলেছে। আশ্রয় নেবেন বলে ভিশ্চার্স বরফে গর্ত খুঁড়তে শুরু করেছেন, স্কট ছিলেন বেশ কিছুটা উপরে। হঠাৎ ভিশ্চার্স দেখলেন সড়াৎ তাঁর পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন স্কট নীচের দিকে। দুজন ছিলেন রশি দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা, ফলে রশিতে টান পড়ায় ভিশ্চার্সও চললেন পিছন পিছন। বার বার শক্ত বরফে আইস অ্যাক্স গাঁথার চেষ্টা করেও সেল্ফ্ অ্যারেস্ট করে পতন ঠেকানো যাচ্ছিল না। আর একটু নীচেই ৮০০০ ফুট খাড়া ঢাল, অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যু। তারপর ভাগ্যক্রমে হঠাৎ করেই ভিশ্চার্সের কুঠারটা গেঁথে গেল বরফে, দড়ি টান টান হয়ে গেল, ঝাঁকিও লাগল খুব জোর তবে পতন ঠেকল। চিৎকার করে জানতে চাইলেন ভিশ্চার্স, ‘ঠিক আছো তো?’ নীচ থেকে স্কটের আর্তনাদ ভেসে এল। চেঁচিয়ে উত্তর দিলেন তিনি। কী বললেন?
পাঠক, স্কটের উত্তরটা আমি এখানে বলব না, পাতা উল্টে দেখে নিতে হবে আপনাকেই। কথা দিতে পারি, হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।