ফ্ল্যাপে লিখা কথা ‘মানুষটি’ ১৫টি গল্পের সংকলন। সাত বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে লেখা গল্পগুলো সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে। সময়ের ব্যবধানের ফলে বিচিত্র বিষয় এবং অনুষঙ্গ ঐ গল্পগুলোকে যেমন করেছে জীবনমুখী তেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ।
এসব গল্পের কোথাও আছে একজন ব্যক্তির কথা, যে অনবরত নিজেকে খুঁজে বেড়ায়। কোথাও আছে একজন হতদরিদ্র নারীর কথা , যে ছেলেকে লেকাপড়া শেখানো জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়, কিন্তু একদিন ফিরে আসে ছেলের লাশ , সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হয়ে । আছে ভালোমানুষকে ভালোবাসার জন্য যুবতীর প্রাথনা, যে প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়ে গর্ভবতী হয়। আছে পাবর্ত্য চট্রগ্রামের জোর করে পাঠানো একজন বাঙালি অভিবাসীর শান্তিবাহিনীর হাতে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। আছে হাওরের গল্প, পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায় সোনালি ধান, কৃষেকের স্বপ্ন। একজন যুবক নিজের চোখের সামনে দেখতে পায় কীভাবে বদলে যাচ্ছে শহর। গল্পের নায়ক দেখে ‘চোখের সামনে একটি অসুন্দর শহর প্রলব-হয়ে উঠে। ওর মুখ ভরে থুতু আসে। ও ভীত চোখে মহুয়াকে দেখে। এই পতিত জমির অন্ধকার ছেড়ে কোথায় পালাবে।’
এভাবে আরও নানা বিষয়ের গল্প আছে এই বইয়ে, বিষয়কে কেন্দ্র করে কাহিনী তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো গল্পে বিষয় শেখ কথা হতে পারে না, যদি না তা শিল্পকে ছুঁতে পারে। এ বইয়ের গল্পগুলো কাহিনীর বুনন, ভাষা শৈলী এবং আঙ্গিকের সমন্বয়ে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। এই গল্পগ্রন্থ আমরা প্রকাশ করেছি। আমাদের বিশ্বাস এই বই পাঠকের গল্প তৃষ্ণা মেটাবে । ছুঁয়ে যাবে তার শিল্পের সাধ।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।