শিশু-কিশোরদের জন্য আ. শ. ম. বাবর আলীর লেখা একটি গ্রন্থ ‘মজার মজার ছড়া’। শিশুদের জীবন গঠন এবং চিত্তবিনোদনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তেমনি ধরনের অনেকগুলো মজার মজার ছড়া আছে এ গ্রন্থে। একদিন শিশুদের ছিল সুন্দর শৈশব। আজকের শিশুদের সাথে তার পার্থক্য অনেক। তারই বর্ণনা দিয়েছেন ছড়াকার এই গ্রন্থের সূচনা ছড়া ‘ছেলেবেলা’তে। তার কিছু অংশ এমন- ‘তোমরা এখন রাত্রি জাগিয়া দেখো ভিসিআর টিভি,/ রাত্রি জাগিয়া আমরা শুনিতাম পুঁথি সোনাভান বিবি।’...তোমরা ডাকো- ড্যাডি মাম্মি আমরা বাবা ও মা,/ কোনো ডাকে আহা প্রাণ ভরে বেশি তোমরাই বলো না।’ এমনি ধরনের দুই শৈশবের অনেক কিছু বর্ণনা দেওয়ার পর ছড়াটির সমাপ্তি টেনেছেন এমনিভাবে- ‘এমনি কত শৈশব স্মৃতি মনে পড়ে আজ ফের,/ কোনটা মধুর তোমরাই বলো- আমাদের না তোমাদের?’ মাটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মায়াবী বস্তু মনে করে রচিত ‘মাটির মায়া’ ছড়াটি। ঝর্ণাটি তো ছিল অনেক উচ্চে পাহাড়ের ওপরে। সেই উচ্চ স্থান ছেড়ে কেন সে নিচে নেমে এলো? এ প্রশ্নের জবাবে ‘ঝর্ণা বলে- থাকলেও সেথা/ সুখ ছিল না প্রাণে,/ তাইতো নিচে এলাম নেমে/ মাটির মায়ার টানে।’ লেখাপড়া শিখে জ্ঞানলাভের প্রস্তুতিকাল তো শৈশব। তাই ‘পড়াশোনা’ ছড়ায় অমনোযোগী পুত্রের প্রতি রুষ্ট পিতার এমনিভাবে রোষ প্রকাশ - ‘গম্ভীর হয়ে আব্বু বলেন- / মুখটি করে কালো,/ মূর্খ হয়ে থাকার চেয়ে/ মরে যাওয়াই ভালো।’ জীবনে যারা মহৎ হয়, তা তাদের কর্ম দিয়েই হয়। ‘কর্মগুণে’ ছড়ায় কিছু মূল্যবান বস্তু ও গুণী প্রাণীর প্রাণীর কর্ম বিবরণ প্রদান শেষে ছড়াকার বলেন- ‘ওরা সবাই মহৎকর্মে/ মহৎ হয়ে থাকে,/ তোমার মহৎকর্ম গুণে/ বানাও সমাজটাকে।’ পৃথিবীতে শান্তির আশ্রয় যেখানে যতই আছে, মায়ের কোলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ শান্তির জায়গা আর কোথাও নেই। ‘অনুপম’ ছড়ায় সেকথা ধ্বনিত হয়েছে এভাবে- ‘অনেক রকম শীতলতা প্রকৃতিতে দোলে,/ সবার চেয়ে আরাম শীতল আছে মায়ের কোলে।’ পৃথিবীতে যেখানে যত সম্পদ আছে, বইয়ের মতো শ্রেষ্ঠ সম্পদ কোথাও নেই। কারণ জীবনের উন্নতির জন্য জ্ঞানী হতে হয়। আর জ্ঞানী হওয়ার একমাত্র পথ বই পড়া। এ কথা মূর্খরা তো বোঝে না, বোঝে শুধু গুণীজন। ‘বই নিয়ে’ ছড়ায় ছড়াকারের সেই তথ্য- ‘সম্পদ যত আছে/ বই সব সেরা,/ জ্ঞানী হতে পড়ে বই/ গুণী মানুষেরা।’ দুষ্ট-নষ্ট ছেলে তার নিজের তো বটেই সমাজেরও কলঙ্ক। আর শান্ত-সরল ছেলের জীবন হয় সকলের জন্য সমৃদ্ধিময়। ‘দুষ্ট এবং শান্ত’ ছড়াকার তাই বলেন- ‘নষ্ট যে হয় দুষ্ট ছেলের/ জীবন ভবিষ্যৎ,/ সরল যে হয় সুগম যে হয়/ শান্ত ছেলের পথ।’ শৈশব মন বড় ভাবুক, বড় কল্পনাপ্রবণ। তার সে কল্পনা বেশিভাবে আশ্রিত হয়, পাখা মেলে বিশেষ কোনো নির্জন মুহূর্তে। সে নির্জনতা এমনিও হতে পারে, শিশুমনে যার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ‘চৌপহরের ছড়া’তে এমনিভাবে- ‘গভীর রাতে পাখ্-পাখালি/ ঘুমায় আপন নীড়ে,/ মনটা আমার যায় হারিয়ে/ লক্ষ তারার ভিড়ে।’ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনেকে অনেক কিছু হতে চায়। কিন্তু সঠিক পথটি কেউ খুঁজে পায় না। তাই শৈশবেই অনেকেরই শুরু হয় দিশেহারা জীবন। তাদেরই উদ্দেশ্যে ‘ভাবছি মনে’ ছড়ায় ছড়াকারের প্রতিনিধিত্বমূলক দিকনির্দেশনা- ‘অবশেষে অনেক হওয়ার/ ভাবনা বিসর্জনে,/ শুদ্ধ একজন মানুষ হতে/ ভাবছি মনে মনে।’ গ্রন্থটিতে রয়েছে এমনি ধরনের বৈচিত্র্যধর্মী ৪০টি নীতিবোধ এবং বিনোদনমূলক ছড়া। অর্থাৎ একই ছড়ায় একই সাথে নীতি বর্ণনা এবং বিনোদনে সমৃদ্ধ। প্রতিটি ছড়ার সাথে অলংকরণ ছড়াগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। ছড়াগ্রন্থটির সুদৃশ প্রচ্ছদটিও মনোমুগ্ধকর। যতেœর সাথে কাজ দুটি সমবেতভাবে করেছেন রফিকুল ইসলাম ফিরোজ ও এম এ মান্নান।
আ. শ. ম. বাবর আলী জন্ম সাতক্ষীরা জেলার নলতা গ্রামে ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর। ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন নলতা হাইস্কুল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ. পাস করেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৮ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. এড. পাস করেন। পরবর্তীতে বিসিএস। একটা বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয়। পরে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০০ সালে চাকুরি থেকে পুরোপুরি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে মওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে। পরবর্তীতে ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, সওগাত, মোহাম্মদী, সমকাল, মাহে-নও, ঝিনুক, সাতরঙ প্রভৃতি দৈনিক ও মাসিক পত্রিকাতে তাঁর লেখা প্রবন্ধ, গল্প, ছড়া, কবিতা ইত্যাদি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। অনেকগুলো সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম- সুমন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), সাহিত্যে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, ক্যাম্ব্রিজ, লন্ডন (১৯৯২), শিরি শিশুসাহিত্য সম্মাননা (১৯৯৩), কালিগঞ্জ সাহিত্য একাডেমি স্বর্ণপদক (১৯৯৯), কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার (১৪০৭ বঙ্গাব্দ), দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ স্মারক প্রতিবিম্ব পুরস্কার (২০০১), সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি স্বর্ণপদক পুরস্কার (২০০২), বাঁধনহারা লিটলম্যাগ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৭), অগ্রদূত সাহিত্য সম্মাননা (২০০৭),