"নির্বাচিত প্রবন্ধ"বইটির ১ম ফ্লাপের কিছু কথা: লেখক অনেকেই হন, তবে মনীষী-লেখক আমরা তাদেরকেই বলি যাদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ ও যুগােত্তরের স্বপ্ন ও সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। সদ্যপ্রয়াত আহমদ ছফা ছিলেন। আমাদের দেশের সেরকম এক বিরলদৃষ্ট মনস্বিতাসম্পন্ন লেখক। লিপিকুশলতার সঙ্গে মনীষার এমন মণিকাঞ্চন যােগ সচরাচর ঘটে না, সব লেখকের বেলায় তাে নয়ই। আহমদ ছফার প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অন্তদৃষ্টি, ইতিহাসবােধ, ঐতিহ্যসচেতনতা, মানবপ্রীতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে। সাহিত্যিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর মৃত্যুজনিত শূন্যতা আমাদের মধ্যে এই বােধকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাঁর জীবদ্দশায় যারা হয়তাে অনেক বিষয়েই তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন না এমনকি তাদের পক্ষেও তার চিন্তার প্রাতিস্বিকতা ও প্রতিভার মৌলিকত্বকে স্বীকার না করে উপায় ছিল না। একইভাবে আজ ও আগামীদিনেও তাঁর রচনার শরণাপন্ন আমাদেরকে হতে হবে। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও আহমদ ছফা তাঁর অতুলনীয়। দক্ষতার পরিচয় দিলেও, তার মনীষার শ্রেষ্ঠ ফসল বােধ করি তাঁর প্রবন্ধগুলি। বর্তমান সংকলনের সম্পাদক যাকে আমাদের গত অর্ধ-শতাব্দীর চিন্তাচর্চার সেরা প্রসূন বলে উল্লেখ করেছেন। সেই প্রবন্ধসম্ভার থেকে বাছাই করা ৪৪টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে আহমদ ছফার নির্বাচিত প্রবন্ধ বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা নিজেদের গর্বিত বােধ করছি। শিল্পসাহিত্য, সমাজ-রাজনীতি, ইতিহাস-অর্থনীতি সকল বিষয়েই শ্রেষ্ঠ ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এ-বইয়ে। মাওলা ব্রাদার্স ইতিপূর্বেও এই মনীষী-লেখকের ক’টি বিশিষ্ট গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্কের বাইরেও তাঁর সঙ্গে আমরা এক গভীর মমতা ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। ছিলাম। তার মৃত্যুতেও আমরা মনে করি তাতে ছেদ ঘটেনি। তার উপদেশ-পরামর্শ আজও আমাদের চলার পথের পাথেয়। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশসহ যে-পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছি তার অংশ হিসেবে আমাদের এ দ্বিতীয় প্রকাশনাটি আশা করি পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।