ফ্ল্যাপে খেলা কিছু কথা কথাশিল্পী হিসেবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর জীবনকালেই সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এক মর্যাদার আসন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু যাকে বলে বিশুদ্ধ মমনচর্চার ক্ষেত্রে সেই প্রবন্ধসাহিত্যেও তাঁর শিখরস্পর্শী সাফল্য সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়ত সেভাবে অবহিত নই।মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তাঁর এই একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ সংস্কৃতির ভাঙা সেতু-তে পাঠক তাঁর প্রতিভার সেই অন্যদিকটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। গল্প-উপন্যাসের মতো এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন এক স্বল্পপ্রজ লেখক।আবার তাঁর সৃষ্ট কথাসাহিত্যের মতোই প্রবন্ধগুলোও তাঁর গভীর জীবনবোধ, বিষয়কে তার সমগ্রতায় দেখার চোখ এবং শিল্পীর দায়বদ্ধতায় তাঁর বিশ্বাসকে তুলে ধরে।লেখক বা সংস্কৃতিকর্মীর দায়িত্ব, উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতা, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পদৃষ্টি, বুলবুল চৌধুরীর প্রতিভা, রবীন্দ্র সঙ্গীতের শক্তি, সূর্যদীঘল বাড়ি বা গান্ধী চলচ্চিত্র, ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ কিংবা কায়েস আহমেদ বা অভিজিৎ সেনের মতো কথা বলুন না কেন? তাঁর সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ক্ষমতা আমাদেরকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করে। এমনকি যেখানে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত নই সেখানও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে আমরা পারি না। তাঁর গল্প-উপন্যাসের মতোই প্রবন্ধগুলোও হয়ত একটানে পড়া যায় না। ভাবতে-ভাবতে পড়তে হয়, আবার পড়তে পড়তে থমকে ভাবতে হয়। কখনো তা পাঠককে ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘জীবনযাপনের মধ্যে মানুষের গোটা সত্তাটিকে’ প্রকাশের যে দায়িত্বের কথা ইলিয়াস বলেছেন ‘চিলেকোঠার সেপাই’বা ‘খোয়াবনামা’র পেছনে তাদের স্রষ্টার সে নিখাদ দায়বোধ ও দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির চিনে নিতেও প্রবন্ধগুলো আমাদের সাহায্য করে। সূচিপত্র *সংস্কৃতির ভাঙা সেতু উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা *সংশয়ের পক্ষে *মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাগী চোখের স্বপ্ন *বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে? *রবীন্দ্রসংগীতের শক্তি *বুলবুল চৌধুরী *শওকত ওসমানের প্রভাব ও প্রস্তুতি *স্মৃতির শহরে কবির জাগরণ *ক্ষুদ্ধ শহীদ ক্লান্ত শহীদ *আসহাউদ্দীন আহমেদের ক্রোধ ও কৌতক *কৌতুকে ক্রোধের শক্তি *জতুগৃহে দিনযাপন *মরিবার হ’লো তার সাধ *প্রসঙ্গ : সূর্যদীঘল বাড়ি *অভিজিৎ সেনের হাড়তরঙ্গ *লেখকের দায় *সায়েবদের গান্ধি *গুণ্টাগ্রাস ও আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার *সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের খাতে প্রাথমিক শিক্ষা *একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ ও গতি *চাকমা উপন্যাস চাই *
গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মামাবাড়ি। এই মাতুলালয়েই ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পূর্ণনাম আখতারুজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস হলেও মঞ্জু ডাকনামেও তার পরিচিতি রয়েছে। পৈতৃক বাড়ি ছিলো বগুড়ায়, তাই বগুড়া জিলা স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, যেখান থেকে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আগাগোড়া। জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক পদ থেকে শুরু করে মিউজিক কলেজের উপধ্যাক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক পদেও নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার প্রতিও ঝোঁক ছিলো তার, লিখেছিলেন কয়েকটি কবিতা, তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা কখনো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশিত হয়। তার বাচনশৈলী সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রথমদিকে বেশ খটমটে লেগেছিলো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৭ সালে। এছাড়াও আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার আরেকটি উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। আখতারুজ্জামান এর বই সমগ্র-তে মোট দুটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধ সংকলন রয়েছে। ‘খোয়াবনামা’কে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হলেও আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের ছোটগল্পগুলোও পেয়েছে সমালোচকদের প্রশংসা। তার রচনা বিশ্লেষণধর্মী। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন বিধায় রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ ছিলো স্বাভাবিক ঘটনা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর বই সমূহ-তে তাই স্বাদ পাওয়া যায় রাজনীতির, এবং তার লেখার মাধ্যমে সমষ্টি ও ব্যক্তিকে দিয়েছেন সমান মর্যাদা। মুক্তমনা এ লেখক ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিবির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র এবং বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি এই সৃষ্টিশীল লেখক ইহলোক ত্যাগ করেন।