ফ্ল্যাপে লিখা কথা কোনো সংগ্রাম বা প্রয়াসের তাৎক্ষণিক ফলাফল দিয়ে তার মহত্ত্ব বা যৌক্তিকতা বিচার হয় না। কিছু ঘটনা পরবর্তী ইতিহাসের ওপর গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়। যুগোত্তরে মানুষকে যা উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করে। ১৯৩০ সালে সূর্য সেন ও তাঁর সাথীদের উদ্যোগে সংঘঠিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ছিল তেমনি একটি ঘটনা। সূর্য সেন ও তাঁর সাথীরা কিংবা তাঁদের মতো অন্য বিপ্লবীরা সেদিন দেশকে স্বাদীন করার জন্য যে পথ গ্রহণ করেছিলেন তার সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন বা মতপার্থক্য থাকতে পারে। বিশাল ভাবতবর্ষের একপ্রান্তে একটি এলাকাকে কয়েকটা দিন মাত্র স্বাধীন রেখে যে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো যাবে না, সে কথা মনে হয় সূর্য সেন ও তাঁর সঙ্গীরাও জানতেন। আসলে তাঁরা যা চেয়েছিলেন তা হল বড় বকমের একটা নাড়া দিতে। সেই সঙ্গে স্বাদীনতা সংগ্রামের নিয়মতান্ত্রিক ধারাটিকে প্রভাবিত করতে। আর সে-কাজে তাঁরা যে সফল হয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সব চেয়ে বড় কথা, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত তাঁরা সেদিন স্থাপন করেছিলেন তা, আমাদের তো বটেই, সকল কালেই সকল দেশের মানুষের প্রেরণার উৎস হতে পারে। স্বাদীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম বইটিতে পূর্ণেন্দু দস্তিদার সেই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের আনুপূর্বিক বিবরণ অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে ও তথ্যনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। লেখক নিজেও ছিলেন বিপ্লবীদের এক নবীন সহযাত্রী। সেদিক থেকে বইটির একটি আলাদা মূল্য তো আছেই, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বে বইটির প্রকাশ এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ এর সংগ্রাম-উত্তাল দিনগুলোতে এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে বইটি দেশের তরুণদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। দীর্ঘদিনের দুষ্প্রাপ্যতার অবসান ঘটিয়ে বইটি নতুনভাবে প্রকাশ করতে পেরে আমরা যার পর নেই আনন্দিত।
পূর্ণেন্দু দস্তিদারের জন্ম ১৯০৯ সালের ২০ জুন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানাধীন ধলঘাট গ্রামে। তার বাবা চন্দ্রকুমার। দস্তিদার চট্টগ্রাম আদালতে চাকরি করতেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর পুর্ণেন্দু দস্তিদার যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তার আগে স্কুল-কলেজে পড়া অবস্থায়ই তিনি বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র তখনই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিযােগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে এবং পরে মেদিনীপুরের হিজলি জেলে ও রাজপুতানার দেউলি জেলে বন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। বন্দি অবস্থায়ই তিনি ডিস্টিংশনসহ বিএসসি ও পরে ল পাশ করেন। এই বন্দিজীবনেই মার্কসবাদী তত্ত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যােগাযােগ ঘটে তার, যা আমৃত্যু স্থায়ী হয়। দেশভাগের পর আইন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এই বন্দি অবস্থায়ই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়নে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরিষদে তিনি চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের শহীদদের স্মৃতিতে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব করলে তা গৃহীত হয়। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ন্যাপ-এর চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় অসুস্থ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৯ মে ভারতের উত্তপূর্বাঞ্চলের বাজেতলাং সীমান্ত ঘাঁটিতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তিন দফায় পাকিস্তানি শাসনামলের তেইশ বছরের ষােল বছরই পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে কারান্তরালে কাটাতে হয়। বন্দি অবস্থায় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম (১৯৬৭) ছাড়াও তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ হল কবিয়াল রমেশ শীল (১৯৬৩) ও বীরকন্যা প্রীতিলতা (১৯৭০)! এছাড়াও তিনি শেখভ ও মোপাসার গল্প অনুবাদ করেন।