নিবেদন প্রায় ২২ বৎসর পূর্ব্বে এই উপন্যাসখানি লিখিত হইয়াছিল। ইহার পাণ্ডুলিপি তদানীন্তন প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার পরলোকগত বাবু জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়, এম্-এ, বি-এল্ মহোদয়কে প্রদর্শন করা হইয়াছিল। তিনি তাহা পাঠ করিয়া সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং অনেক স্থানে "Beautiful" এবং "Most Beautiful" বলিয়া মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। তিনি তাহা পরিষ্কার করিয়া পুনরায় লিখিতে উপদেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু নানা কারণে আমি এতদিন তাহা লিখিতে (Revise করিতে) পারি নাই। এখন পুনলিপি করিতে অনেক স্থল পরিবর্ত্তিত, পরিবর্দ্ধিত ও পরিবর্জ্জিত হইয়াছে। কেবল উৎসর্গপত্রখানি পূর্ব্ববৎ অবিকৃত রহিয়াছে।
আজি মনে পড়ে, আমার ভক্তিভাজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধর্ম্ম ও সমাজ সম্বন্ধে একটি গল্প বলিয়াছিলেন; সমস্ত গল্পটী মনে নাই, এইটুকু কেবল স্মরণ হয় :
এক জন ধর্ম্ম-পিপাসু ব্যক্তি জনৈক দরবেশের নিকট যোগ শিক্ষা করিতে চাহিল। তাহাতে দরবেশ বলিলেন, “চল আমার গুরুর নিকট।” সে গুরু একজন হিন্দু। হিন্দু সাধু বলিলেন, “আমি কি শিখাইব, আমার গুরুর নিকট চল।” তাঁহার গুরু আবার একজন মুসলমান দরবেশ!! শিক্ষার্থী দরবেশকে এই হিন্দু-মুসলমানে মিশামিশির কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন:
ধর্ম্ম একটী ত্রিতল অট্টালিকার ন্যায়। নীচের তলে অনেক কামরা, হিন্দু-ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা; মুসলমান, শিয়া, সুন্নী, হানাফী, সাফী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়; ঐরূপ খ্রীষ্টান, রোমান-কাথলিক, প্রোটেষ্টান্ট, ইত্যাদি। তাহার উপর দ্বিতলে দেখ, কেবল মুসলমান, সবই মুসলমান; হিন্দু, সবাই হিন্দু ইত্যাদি। তাহার উপর ত্রিতলে উঠিয়া দেখ, একটী কক্ষ মাত্র, কামরা বিভাগ নাই অর্থাৎ মুসলমান, হিন্দু, কিছুই নাই-সকলে একপ্রকার মানুষ এবং উপাস্য কেবল এক আল্লাহ্। সূক্ষ্মভাবে ধরিতে গেলে কিছুই থাকে না-সব ‘নাই’ হইয়া কেবল আল্লাহ্ থাকেন।
ইতিপূর্ব্বে ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের কোন অংশ কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নাই; সুতরাং এবার পাঠকগণ বলিতে পারিবেন না যে ইহা ‘পুরাতন জিনিষ; অনুক কাগজে দেখিয়াছিলাম’!
ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বাবু বিনয়ভূষণ সরকার বি-এ, বি-টি, মহোদয় অনুগ্রহপূর্ব্বক “পদ্মরাগে”র প্রুফ আদ্যন্ত দেখিয়া দিয়াছেন এবং ইহার ভূমিকা লিখিয়াছেন, সে জন্য তাঁহার নিকট আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ আছি।
“পদ্মরাগে” আর যাহা কিছু ত্রটী রহিল, তাহার কারণ লেখিকার বিদ্যাবুদ্ধির দৈন্য। আশা করি, গুণগ্রাহী পাঠক ও পাঠিকাগণ তাহা মার্জ্জনা করিবেন।
(সাহিত্যসেবী মহলে তিনি বেগম রোকেয়া নামেই সমধিক পরিচিত; ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ - ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁকে বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তার প্রকৃত নাম "রোকেয়া খাতুন" এবং বৈবাহিকসূত্রে নাম "বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন"। রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তিনি একজন অসাধারণ নারী।১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বিয়ের পর তিনি "বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন" নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তাঁর কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন । বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে 'নারী জাগরণের অগ্রদূত' হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন । উল্লেখ্য , নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি।ছাড়াও, মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য "রোকেয়া হল" নামকরণ করা হয়। রোকেয়ার তাঁর নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন মতিচূর প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯২২)। সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি তাঁর সৃজনশীল রচনা। তাঁর সুলতানার স্বপ্নকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়।