ফ্ল্যাপে লিখা কথা এ এক অন্য পৃথিবী, এ এক অন্য ভাষার কথকতা। হাজার বছর ধরে বাংলার লোকগান অবলীলায় ধারণ করেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক সহজিয়া-তান্ত্রিক-বৈষ্ণব-সুফি ভাবনাকে। একই দেহে লীন হয়েছে নানা উৎসজাত অধ্যাত্ম-ভাবনা। খনি থেকে তোলা আকাটা হীরার মতো অপরিশীলিত বাচন সোঁদা মাটির বুকে নামিয়ে আনে বিপুল আকাশটাকে। তাই বাউল করিম বিভোর হয়ে তাঁর গানের ডালি সাজিয়েছেন। অপনমনে সুরে কথা বসিয়েছেন আর কথাকে করেছেন বিহ্বল ভাবের অনুগামী। তাই তাঁর রচনায় পুনরাবৃত্তির অভাব নেই। যেন প্রিয় পরমের ছবি হৃৎকমলে আঁকতে গিয়ে কিছুতেই সাধ মিটছে না তাঁর। শব্দের সিঁড়ি দিয়ে চেতনার মীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে চাইছেন তিনি এবং প্রতি পলে-অনুপলে অনুভব করছেন, শব্দাতীতকে শব্দ দিয়ে বাঁধা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাবুক বাউরের কাছে উপকরণ তো বড় নয়; অভ্যস্ত শব্দসজ্জাকে বারবার ব্যবহার করছেন এই বিশ্বাসে সে এর মধ্যে ‘আশিকের ধন পরশরতন’- এই সাক্ষাৎ মিলবে। সন্ত-কবিতার কিছু কিছু পরিচিত শব্দবন্ধ বাউল করিমের প্রগাঢ় অনুভবের দ্যুতিতে নতুন সুরে-তালে-লয়ে বেজে উঠেছে।
রচনাসমগ্রের পাঠকেরা নিশ্চয় লক্ষ করবেন এইসব। নানা উৎস থেকে উৎসারিত অজস্র নদী যেমন আপন বেগে পাগলপারা হয়ে স্বতন্ত্র উপস্থিতি ঘোষণা করে তবু সাগর-মোহনায় পৌঁছে অসামান্য ঐক্যবোধে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, শাহ আবদুল করিমের রচনাসম্ভাবও তেমনি বহুমাত্রিক লোকায়ত চেতনার সংশ্লেষণে সমৃদ্ধ হয়েই অদ্বিতীয় অনুভবের আলো বিচ্ছুরণ করে। ‘নির্ধনের ধন রে বন্ধু আঁধারের আলোক’, ‘নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী অকূল সাগরে’, ‘শতবর্ণের গাভী হলে একই বর্ণের দুগ্ধ মিলে’, ‘বন্ধু রে, তিলেক মাত্র না দেখিলে কলিজায় আগুন জ্বলে’ এবং এরকম অজস্র পঙ্ক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে শাহ আবদুল করিম বাংলার আবহমান লোকায়ত পরম্পরারই সৃষ্টি। বিখ্যাত সেই গ্রিক দার্শনিকের মতো তিনিও মানুষ খুঁজে বেড়ান। এই খোঁজার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যেমন আছে, তেমনি বন্ধন-ভীরু মুক্ত মানুষের কথকতায় রয়েছে আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিস্পর্ধা। ধর্মীয় উন্মাদনা ও শাসকের নগ্ন পীড়নের বিরুদ্ধে তাই তো তিনি নিজের স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেন। এইজন্যে কেবল বাউল করিমের জীবন ব্যাপ্ত সাধনার তাৎপর্য পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।
তবে এটা নিশ্চিত যে শাহ আবদুল করিরে রচনাসমগ্র প্রত্যেকের কাছেই অমূল্য সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক হিসেবে গণ্য হবে। কেননা আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার প্রহরে ঐতিহ্যের বাতিঘরই আমাদের চূড়ান্ত আশ্রয়।