যােগাসন এবং ব্যায়াম—দুটির ব্যাপারেই আমার যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, কিন্তু এগুলাে নিয়ে কোন আদিখ্যেতা নেই। আমি কখনই মনে করিনা এগুলাে করলেই মানুষের সারাজীবন কোন অসুখ বিসুখ হবে না কিংবা যে কোন রােগই সেরে যাবে অথবা জীবনে একবারও তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি, নিয়মিত যাঁরা এগুলাে করেন, তারা অবশ্যই কিছু উপকার পেয়ে থাকেন। আমি অনিয়মিতভাবে এগুলাে করেও নানা সময়ে নানা উপকার পেয়েছি। সবথেকে বড় কথা হল, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে, কাজকর্মে উৎসাহ আসে। তবে পাশাপাশি বয়স, ওজন ও কাজকর্মের ধারা অনুযায়ী সুষম খাদ্যগ্রহণটাও জরুরি। কিন্তু মুস্কিলটা হল, এ ব্যাপারে আপনাকে গাইড করবে কে? পাড়ায় পাড়ায় এখন জিমখানা, সবাই স্বঘােষিত প্রশিক্ষক। কেউ কেউ স্বঘােষিত ডাক্তারও হয়ে গেছেন। কোনও বকচ্ছপ প্যাথির একখানা ডিগ্রিও জোগাড় করে ফেলেছেন নগদ মূল্যের বিনিময়ে এবং নামের শেষে সেটা লাগিয়ে ব্যায়াম শেখানাের পাশাপাশি ডাক্তারিও চালাচ্ছেন। এই হাতুড়েরা এমনও প্রচার করছেন যে হার্ট, থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, যৌনসমস্যা, এমনি ক্যানসারও তারা সারিয়ে দিচ্ছেন। কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন বহু মানুষ এদের কথা বিশ্বাস করে চিকিৎসা বন্ধ করে শুধু ব্যায়াম আর আসনই করে যাচ্ছেন। অঘটনও ঘটছে। আমার এক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগতেন, সুগার চারশ-পাঁচশ উঠে যেত, ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন ইনসুলিন ইনজেকশন কিছুদিন নিতে, সঙ্গে খাওয়ার ওষুধ। তিনি পড়লেন এক যােগ থেরাপিস্টের পাল্লায়। সব বন্ধ করে শুধু আসুরিক কিছু কসরৎ এবং তার সঙ্গে অবৈজ্ঞানিকভাবে প্রস্তুত এক ডায়েট চার্ট ফলাে করে তিনি মাস ছয়েকের মধ্যে ডায়াবেটিক কোমাতে মারা গেলেন।
একটা কথা পরিষ্কার করেই বলি যে এই যােগাসন ও ব্যায়াম বিশেষজ্ঞরা কেউই ডাক্তার নন, এঁদের অধিকাংশই বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রশিক্ষিতও নন। কাজেই শরীর ফিট রাখতে এঁদের পরামর্শ নিতেই পারেন, কিন্তু অসুখ হলে আগে ডাক্তারের পরামর্শই নেবেন। তারপর এঁদের। যেমন কারও যদি ঘাড়ের বাত বা সার্ভাইকাল স্পনডাইলােসিস হয়, সেটা এক্সরে দেখে বুঝবেন কোনও অস্থি বিশেষজ্ঞ। তাকে দিয়ে আগে চিকিৎসা করাবেন। রােগের তীব্রতা কমলে তারপর কোন প্রশিক্ষিত যােগথেরাপিস্টের কাছে গিয়ে ব্যায়াম করবেন। তা না করে ঘাড়ের তীব্র ব্যথায় আপনি যদি আগে তাঁর কাছে যান, তিনি রােগটা ধরতে পারবেন না, কারণ তিনি ডাক্তার নন, অস্থি বিশেষজ্ঞ তাে ননই।
আমার এই ভূমিকা পড়ে, যােগবিদ বা ভুইফোড় ম্যাসিওর, যাঁরা নিজেদের ফিজিওথেরাপিস্ট বলে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন, তারা রাগ করতেই পারেন। কিন্তু আমি নিরুপায়। স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা জগতের এই দু'নম্বরীদের বিরুদ্ধে আমার এই কলমের লড়াই দু'দশক ধরেই চলছে। আমৃত্যু চলবেও।
আমার স্নেহভাজন জয়ন্ত যখন যােগাসন ও ব্যায়াম নিয়ে কিছু লেখার পরিকল্পনার কথা আমায় বলে, আমি ওকে বললাম, আমাদের দেশে বহু যুগ ধরে এগুলাের একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে, এই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বহু মানুষ এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তারা এই নিয়েই কাজ করেছেন, তুমি তাদের ইন্টারভিউ করাে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা মানুষকে শােনাও। কারণ এই মানুষগুলাে সত্যিই জীবনে জীবন যােগ করেছেন, শিখতে হলে এঁদেরকে অনুসরণ করেই আমরা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যােগাসন ও ব্যায়াম শিখব। জয়ন্ত রাজি হল। এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ বই লিখলাে। আমি বাজি রেখেই বলতে পারি, বাজারি যে কোন বই-এর থেকে জয়ন্তর বই এক্কেবারে আলাদা, নিজস্ব বিশিষ্টতায়। সমুজ্জ্বল। ঝরঝরে গদ্য লেখে জয়ন্ত, ওর লেখনী সচল থাকুক, ও নিজে সুস্থ। থাকুক এবং এই বই পড়ে আপনারাও সুস্থ জীবনের অধিকারী হন—এই আশা নিয়েই শেষ করছি।