বাংলা নাটকের উদ্ভব বিগত ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে এদেশে বাংলা সাহিত্যের যে সকল বিভাগে নূতন প্রাণ-সঞ্চার হইয়াছিল, নাটক তাহাদের অন্যতম। পূর্বেই বলিয়াছি, বাংলা গদ্য কিংবা গীতি-কবিতার মত নাটক এই দেশের সাহিত্যে পূর্ব হইতেই যে অপরিচিত ছিল, তাহা নহে—কিন্তু তথাপি এই কথা সত্য, এই দেশে পূর্ব হইতেই নাটক-সম্পর্কিত যে ঐতিহ্যের ধারা চলিয়া আসিতেছিল, তাহা ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু পূর্ব হইতেই নিষ্প্রাণ ও গতিশক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছিল। ইংরেজি নাটকের প্রভাববশতই একদিক দিয়া যেমন তাহার মধ্যে নূতন প্রাণ স্পন্দিত হইয়া উঠিল, অন্যদিক দিয়া তেমনই একান্তভাবে পাশ্চাত্ত্য নাটকের অনুকরণেও বাংলায় নূতন নাটক রচিত হইতে লাগিল। এই উভয় ধারা কিছু কাল স্বাধীনভাবে অগ্রসর হইবার পর কালক্রমে শেষ পর্যন্ত একাকার হইয়া গিয়া দেশীয় এবং পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের একটি মিশ্র ধারার সৃষ্টি করিল । কালক্রমে এই দেশীয় প্রাচীন এবং পাশ্চাত্ত্য আধুনিক উভয়েরই বিশিষ্ট প্রভাব হইতে মুক্ত হইয়া বাংলা নাটক বাঙ্গালীর এক জাতীয় রস-সম্পদে পরিণত হইয়াছে ।
দীনবন্ধু মিত্রের পরিচিতি (১৮২৯-১৯৭৩) দীনবন্ধু মিত্র ১৮২৯ গোপালনগর, উত্তর চব্বিশ পরগণার, চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। দীনবন্ধু মিত্রের পিতৃদত্ত নাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ । দরিদ্র পরিবারে জন্ম দীনবন্ধু মিত্রের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য পাঠশালায় । সেখানে কিছুদিন পাঠ গ্রহণের পর তাঁর পিতা তাঁকে জমিদারের সেরেস্তায় কাজে নিযুক্ত করে দেন। কিন্তু বিদে্যুৎসাহী দীনবন্ধু মিত্র কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং পিতৃব্যের ঘরে এসে বাসন মেজে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এই সময়ে দীনবন্ধু মিত্র নাম গ্রহণ করে জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয় পড়াশোনা শুরু করেন। পরে কুলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের শেষ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৫১ সালে আবার উচ্চতর পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৫২ তৃতীয় থেকে সিনিয়র বৃত্তি লাভ করেন। প্রত্যেক পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনিই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন । এরপর সম্ভবত কোথাও শিক্ষকতা করেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। কারণ ১৮৫৩ সালে তিনি টিচারশিপ একজামিনেশনে কৃতকার্য হয়েছিলেন। কলেজের সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৫৪ সালে তিনি পাটনায় পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন । ক্রমে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং তিনি ওড়িশা, নদিয়া ও ঢাকা বিভাগে এবং পরে কলকাতায় সুপারিনটেন্ডেন্ট পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। ১৮৭১ সালে লুসাই যুদ্ধে ডাক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য কাছাড় প্রেরিত হন। এই সময়ে তাঁর তদারকি কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার তাকে দীনবন্ধু মিত্রকে ‘রায়বাহাদুর' উপাধী প্রদান করেন। ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণং নাটকং- এর প্রকাশ হয়। পরে ১৮৬১ সালে A Native' ছদ্মনামে মধুসূদন দত্ত কর্তৃক Nil Durpoun, Or Indigo planting Mirror নামে নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। A Native' কে? তিনি হলেন আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেই । দীনবন্ধু মিত্র সহ কয়েকজন বন্ধু মিলে কৃষ্ণনগরে একটি মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে ‘নবীন তপস্বনী'র প্রকাশিত হয়। এর পরপরই 'বিয়ে পাগলা বুড়ো' প্রহসন ও ‘সধবার একাদশী' নাটক প্রকাশ হয়। ১৮৭২ সালের শেষের দিকে দীনবন্ধু মিত্রকে বদলি করা হয় ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ইন্সপেক্টর রূপে। এরপর ১৮৭৩ সালে ইন্সপেক্টিং পোস্টমাস্টার রূপে অবনমিত হয়ে হাওড়ায় বদলি । ডাক বিভাগের উচ্চস্তরের কর্মচারী হয়েও উপযুক্ত বেতন তিনি পাননি বরং অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানিজনিত কারণে দীনবন্ধু মিত্র মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে ১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন । বাংলা নাট্যসাহিত্যের পটভূমি নাট্য সমালোচক নিকলের মতে নাটক জীবনসম্বন্ধীয় ধারণার এমন ধরণের কাব্যিক প্রকাশ যা অভিনেতারা রূপ দিতে পারে এবং যা শব্দমাধুর্য শোনার জন্য ও আঙ্গিক