"রবীন্দ্র জীবন কথা" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: রবিপ্রতিভা সেই জাতের যার বৈশিষ্ট্য অবিরল বেড়ে ওঠায়, অবিরল হয়ে ওঠায়, যার তার বাঁধতে কিছু দেরি হয়, কিন্তু বাঁধা হয়ে গেলে গান আর থামে না।... রবীন্দ্রনাথ তার সমসাময়িক ইএটসের মতাে তার দীর্ঘায়ু শুধু যে সার্থক করেছিলেন তা নয়, তাতে তার প্রয়ােজন ছিল, কেননা, মুখমণ্ডলের প্রতিটি কালকুঞ্চনের সঙ্গে আরও বড়াে হয়েছেন তিনি...” লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু এবং সেই একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি, “এ-বিষয়ে তিনি সচেতন যে জীবনীকারের অভিব্যক্তি জীবনীর অভিব্যক্তির প্রতিকূল; তিনি প্রশংসনীয় চেষ্টা করেছেন অভিভূত না-হতে, সুযােগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের মতের বিরুদ্ধে তর্ক তুলেছেন, রচনার দুর্বল অংশগুলিকে দুর্বল বলেই ঘােষণা করতে দ্বিধা করেননি।” যে-বইকে উপলক্ষ করে এই মন্তব্য, সেই ‘রবীন্দ্রজীবনী’ চার খণ্ড, সন্দেহ নেই, প্রভাতকুমারের জীবনের বৃহত্তম এবং মহত্তম কীর্তি। এই চার খণ্ড জীবনীকে আবার একটিমাত্র সংহত নিটোল খণ্ডে রূপান্তরিত করেছিলেন প্রভাতকুমার ‘রবীন্দ্রজীবনকথা’ নামে। সুদীর্ঘকাল অমুদ্রিত ছিল এই অসামান্য গ্রন্থটি। নব্বই বছরের প্রাণচঞ্চল যুবা প্রভাতকুমার কর্তৃক আদ্যন্ত সংশােধিত হয়ে আবার প্রকাশিত হল। ‘রবীন্দ্রজীবনকথা’ নামেই সংস্করণ, কিন্তু বস্তুত এ এক নতুন বই হাফটোন ছবি ও কবিতার ফ্যাকসিমিলি যুক্ত হয়েছে, রবীন্দ্র গ্রন্থপঞ্জীকে আদ্যন্ত পরিমার্জনায় করে তােলা হয়েছে আরও তথ্যবহুল ও সাম্প্রতিকতম, রবীন্দ্রজীবনের ঘটনাঘন বৎসরগুলিকে ধরা হয়েছে ‘ঘটনাপঞ্জী নামের নতুন এক সংযােজনে। এমন বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধন ‘রবীন্দ্রজীবনকথা’র আনন্দ-সংস্করণকে নতুন মূল্যে করেছে। গৌরবান্বিত, বাড়িয়েছে এর আকর্ষণ ও প্রয়ােজনীয়তাকে।
Provatkumar Mukhapadhaya- (১৮৭৩-১৯৩২) জন্ম বাংলায়, কিন্তু লেখাপড়া মূলত বিহারে। পাটনা কলেজ থেকে বি এ পাশ করে (১৮৯৫) ভারত সরকারের নানা ধরনের কর্মেও বাংলার বাইরে অনেককাল কাটান। লেখালিখির শুরুও ১৮৯৫ সালের দিকেÑ প্রথমে কবিতা, পরে রবীন্দ্রনাথের কুন্তলীন পুরস্কার তিনিই লাভ করেন (১৮৯৭)। সাহিত্যচর্চার সূত্রে ভারতী-সম্পাদিকা সরলা দেবীর সঙ্গে পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা হয়। তার ফলেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকূল্যে দুই পুত্রের এই বিপদে পিতার পক্ষে বিলেত যাওয়া (১৯০১) এবং ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরা (১৯০৩) সম্ভবপর হয়। তবে মায়ের অনুমতির অভাবে ঈস্পিত বিয়ে হতে পারেনি। প্রভাতকুমার কিছুকাল দার্জিলিং, রংপুর ও গয়ায় আইনব্যবসা করেন। তারপর নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকা-সম্পাদনার সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত থাকেন (১৯১৬-২৯)। মাহারাজারই চেষ্টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন-কলেজে শিক্ষকতার কর্ম লাভ করেন (১৯১৬-৩৩)। প্রভাতকুমার বিশেষ সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন ছোটোগল্প-রচনায়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান স্বীকৃত হয়েছিল। তিনি বাস্তব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করেননি, এমন কথা বলা হয়ে থাকে। তবে দেশ ও বিদেশের পটভূমিকায় তিনি বহু ঘটনা ও চরিত্র এমনভাবে স্থাপিত করেছেন যাতে তারা প্রাণের স্পর্শ লাভ করেছে। তাঁর গল্পের সরসতা অনেক সময়ে প্রকাশলাভ করেছে রঙ্গ ও ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে, তাই বলে গুরুতর ও বেদনাবহ গল্প যে তাঁর নেই, তা নয়। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১২, উপন্যাসের ১৪। প্রভাতকুমারের উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকেরা সাধারণত একমত যে, তাঁর ছোটোগল্পের শিল্পাচাতুর্য তাঁর উপন্যাসে নেই। তিনি জীবনকে দেখেছেন উপর থেকে, জীবনের গভীরতায় প্রবেশ করেননি। তাই এতে যত ঘটনা আছে বা চরিত্র আছে, তুলানায় তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ নেই, অনেক সময়ের ধারাবাহিকতা নেই। তাঁর উপন্যাসে নাটকের গুণ আছে, উপন্যাসের সমগ্রতা অনুপস্থিত। ‘তিনি প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিক নহেন’Ñএকথা বলেও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা উপন্যাসে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর উপন্যাসের বিরূপ সমালোচনা-প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার নিজেই বলেছেন যে, যে-ধরনের ঐক্য (Unity of action) সমালোচকেরা তাঁর রচনায় সন্ধান করেছেন, তা বস্তুত নাটকে প্রত্যাশিত, উপন্যাসে নয়। তিনি ডিকেনসের উপন্যাসের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, খ- খ- চিত্র সেখানে উপন্যভসের সমগ্রতা লাভ করেছে। বড়োর সঙ্গে ছোটোর এমন তুলনা করায় প্রভাতকুমার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি যে, একই সমালোচকেরা তাঁর কোনো উপন্যাসে চরিত্রসৃষ্টির প্রশংসা, কোথাও-বা ঘটনাবিন্যাসের গুণকীর্তন করেছেন। প্রভাতকুমারের যে-দুটি উপন্যাসকে সমালোচকেরা তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা দিয়েছে, তার মধ্যে একটি রতœদীপ, অপরটি সিন্দুরকৌটা। রতœদীপের কাহিনির বাস্তব ভিত্তি থাকা সম্ভবপর। কোনো প্রতারক কোথাও নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির স্থান অধিকার করার চেষ্টা করেছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। তবু সে-ধরনের ঘটনা কী পরিণতি লাভ করে, তা জানতে আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করি। ঘটনাসংস্থানে প্রভাতকুমার এখানে যেমন বৈচিত্র সৃষ্টি করেছেন, দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, চরিত্রসৃষ্টিতেও তাঁর নৈপুণ্য তেমনি স্বতঃ প্রকাশিত। রাখাল প্রতারণা করতেই এসেছিল বটে, কিন্তু বৌরাণীর পাতিব্রত্য তাকে শেষ পর্যন্ত অন্যপথে চালিত করে। তার সংযম উচ্চ আদর্শের দ্বারা প্রণোদিত নয়, নিষ্পাপ বৌরাণী প্রতি আন্তরিক প্রণয়সঞ্চারই তার কারণ। এই মানবিকতাই রাখাল চরিত্রকে বাস্তবের সীমারখোর মধ্যে মহত্বদান করেছে। বৌরাণীর পাতিব্রত্যের মূল তার সংস্কারে, এ-কথা যেমন সত্য, তেমনি তার স্বাভাবিক কোমলতা এবং সংসারের মাধুর্যবঞ্চনাজনিত দুঃখবোধ একসঙ্গে মিলে সে-পতিপ্রেমকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। রাখালকে স্বামী বলে জানার পর তার প্রতি ধাবমান প্রেমকে বৌরাণী যেভাবে ভুল-ভাঙার পর ফিরিয়ে এনেছে, তা তার চরিত্রের ট্রাজিক পরিণামকেই প্রকাশ করেছে। খগেনকেও লেখক অবিমিশ্র পাষ- করে আঁকেননিএজন্যও তিনি সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেছেন। রত্নদ্বীপ উপন্যাসে পাপ-পুণ্যের তৌল বিচার প্রভাতকুমার করেননি। পাপের প্রতি নাহলেও দুষ্টের প্রতি তিনি সহানুভূতি বোধ করেছেন। মানুষের প্রবৃত্তির নিন্দা তিনি করেননি, প্রবৃত্তির আকর্ষণের মাধুর্য সত্ত্বেও প্রয়োজনে তা যে মানুষ জয় করতে পারে, ঔপন্যাসিক তা-ই দেখিছেন। রত্নদ্বীপের পরিণামে ঠিক পুণ্যের জয় দেখানো হয়নি, মানুষেরই মনেই বিরুদ্ধভাবের সমাবেশ তাকে কখন কোন দিকে নিয়ে যায়, তা-ই এতে দেখানো হয়েছে। রাখাল ও বৌরাণী উভয়ের চরিত্রে যে বিজন মনুষ্যত্ব আছে, পাঠক তাকেই সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করছে এবং উপভোগ করেছে। আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়