ভূমিকা প্রথমেই বলে নিই, শিশির রাজনের এই বইটি পাঠ করে আমি চমৎকৃত হয়ে গেছি। সে এখনো কলেজের ছাত্র। কলেজ তার পাঠ্য বিষয় প্রাণিবিদ্যা । কিন্তু সে এই বইটিতে টংক আন্দোলনের যে স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছে তাতে তো তাকে সমাজ-বিজ্ঞানের অত মেধাবী ছাত্র বলে মনে হয়। শুধু মেধাবী নয়, অসাধারণ তার পর্যবেক্ষণ শক্তি। যে-সব এলাকায় টংক আন্দোলন চলেছিল, সে সব এলাকায় নিজে গিয়ে এ আন্দোলনটির স্বরূপ সন্ধানে বস্ত্তনিষ্ঠ অনুশীলন করেছে। হাজংদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছে। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে তার পঠনের পরিধিও অনেক বিস্তৃত। যেখানে যে-বইয়ে এই আন্দোলন সম্পর্কে সামান্য কথাও পাওয়া যায়, সে-সব বইয়ের প্রায় সবই সে পড়েছে। শুধু পড়েনি, সব তথ্যেরই সবিচার বিশ্লেষণ করেছে। টংক প্রথাটি যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামক প্রথাটিরই উপজাত, এ-বিষয়টি বুঝতে সে পড়েছে। শুধু পড়েনি, সব তথ্যেরই উপজাত, এ-বিষয়টি বুঝতে সে একটুও ভুল করেনি। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহই তো প্রকৃত প্রস্তাবে টংক আন্দোলনের স্থপতি। মণি সিংহের ‘জীবন সংগ্রাম’ বইটি রাজন খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়েছে, এবং সে-লেখা থেকে যথাযোগ্য তথ্য ও তত্ত্ব আহরণ করে নিয়েছে। সে-রকমই নিয়েছে খোকা রায়ের ‘সংগ্রামের নিত দশক’ প্রথম গুপ্তের যে সংগ্রামের শেষ নেই, খালেকদাদ চৌধুরীর ‘শতাদ্বীর দুই দিগন্ত’ এবং মৌলবী আব্দুলহান্নানের ‘আমার জীবনে কমিউনিস্টপাটী’ থেকে । মৌলবী আব্দুল হান্নানের বইটির সঙ্গে খুব কম পাঠকই পরিচিত। সেই-বইটি এখন পাওয়াও যায় না। অথচ সে-বইয়ের মৌলবী সাহেব টংক তথা নয়া-সামন্ততন্ত্রের বিভিন্নধরনের শোষণের বিরুদ্ধে নিজের সংগ্রামের সংযুক্তির যে সব বিষয় উদ্ঘটন করে দেখিয়েছেন, সে-সব অন্য কোনো বইয়ে বা লেখায় কেউই দেখাতে পারেন নি। এগুলোর বাইরে অন্য অনেক বইয়েও টংক আন্দোলনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নানাভাবে উঠে এসেছে। সে গুলোর প্রায় সবই শিশির রাজন তার লেখায় তুলে এনেছে। বইয়ের মেষ অংশে রাজন দুটো তালিকা সংযোজন করেছে। একটি ‘টংক আন্দোলনের যাঁরা শহীদ হয়েছেন; অন্যটি ‘আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহন কছের’। েএ রকম তালিকা প্রস্তুত করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য। রাজন যাঁদের নাম সংগ্রহ করতে পেরেছে, তাঁদের বাইরেও হয়তো অনেক শহীদ অংশগ্রহণকারী রয়ে গেছেন। তবু এক্ষেত্রে রাজনের কৃতিকে কোন মতেই ছোট করে দেখা যাবে না। শহীদ এবং অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁদের সম্পর্ক বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে, তাঁদের বিষয়ে সে কিছুটা বিস্তুত আলোচনা করেছে। অন্যদের কেবল নাম উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ রাজন তার লেখায় সর্বত্রই বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় রেখেছে, কোথাও সামান্য ফাঁকিবাজির প্রশ্রয় দেয়নি। আরো বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় শিশির রাজন অবশ্যই আরো কৃতির পরিচয় দেবে। গবেষক রূপে তার ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। রাজনের বইটি পড়ে যে-কোনো পাঠকই টংক আন্দোল সম্পর্কে যথাযথ অবহিতি লাভ করবেন এবং অনেক ভাবনার খোরাক পাবেন। আমি রাজনকে প্রাণভরা স্নেহাশিস জানাই।