"বাঙালির দর্শন : প্রাচীনকাল থেকে সমকাল" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ বাঙালির আর্থ-সামাজিক, সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ঐতিহ্যে যুক্তিবাদী উদারপন্থী চিন্তাভাবনার স্থান ও পরিসর সম্পর্কে কারাে-কারাে মনে গুরুতর সংশয় ও বিভ্রান্তি লক্ষণীয়। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই, এমনকি খােদ দর্শনের অধ্যাপকদের কেউ-কেউ, বাঙালির আবেগাতিশয্য ও দার্শনিক দারিদ্র্য সম্বন্ধে প্রায়শই দুঃখ করে থাকেন। তাদের আক্ষেপ, বাঙালির ধর্মকর্মের ঐতিহ্য আছে, বর্ণাঢ্য কাব্যসাহিত্য ও শিল্পকলা আছে, কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ ও জীবনবাদী কোনাে উদার অসাম্প্রদায়িক দর্শন নেই। এ ধরনের নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক অভিমত যারা পােষণ করেন, তাঁদের মতে বাঙালিমাত্রই আবেগপ্রবণ, কর্মকুণ্ঠ, জীবনবিমুখ ও পরলােকমুখী। দর্শনচর্চার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও যুক্তিনিষ্ঠার প্রয়ােজন, বাঙালির ধাতুপ্রকৃতিতে তার বড়ই অভাব। এই অভিযােগের পেছনে যে কিছুটা সত্যতা আছে তাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার কোনাে অবকাশ নেই। কারণ, জলবায়ুগত কারণেই হােক, আর রক্তসঙ্কর জাতি বলেই হােক, বাঙালির মনে হৃদয়াবেগ একটু বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে বটে। কিন্তু তাই বলে বাঙালির সাহিত্যে যুক্তিবাদী-বুদ্ধিবাদী। মনােবৃত্তির উপস্থিতি ঢালাওভাবে অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করারও কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। যেমন, ষােলাে শতকের বাংলাদেশে চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিবাদ ছিল প্রবল ; কিন্তু তার পাশাপাশি আবার ছিল রঘুনন্দনের নব্যস্মৃতি, রঘুনাথের নব্যন্যায়, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রগ্রন্থ। এসব গ্রন্থে আবেগের পাশাপাশি পাওয়া যায় যুক্তিবিচার, নিদর্শন পাওয়া যায় বাঙালি মনীষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের অনুরূপভাবে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে ধর্মপ্রবণতা, আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক মানসিকতার পাশাপাশি। সমান্তরালভাবে উপস্থিত দেখা যায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী ও ঐহিক ধারা। তাই তাে যথার্থ জীবন বলতে বেশির ভাগ, বাঙালি পারলৌকিক জীবনকে বুঝলেও অন্য অনেকে আবার বুঝেছেন দেহাধারস্থিত সেই চেতনাকে, আধুনিক বস্তুবাদী দর্শনে যাকে অভিহিত করা হয় মস্তিষ্কের ক্রিয়া বলে। এ বিষয়ে আমি নিজে বেশ কয়েক বছর ধরে যৎসামান্য যেটুকু অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করেছি তাতে আমার মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে এবং আমি বর্তমান গ্রন্থে দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, বাঙালির মননশীলতার ইতিহাস কেবল আত্মহারা ভাববিলাস কিংবা আবেগ-উচ্ছাসের ইতিহাস নয়। বাঙালির সত্তায় যেমন আছে ভাবপ্রবণতা, আধ্যাত্মিক-পারলৌকিক মানসিকতা, তেমনি আছে যুক্তিবাদিতা, বস্তুবাদিতা ও ইহজাগতিকতা। আর তা যে প্রাচীনকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত সবসময়ই অব্যাহত এ বিষয়টিই আমি উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে।
অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ১৯৪৩ সালে কুমিল্লা শহর - সংলগ্ন জামবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে প্রবেশিকা এবং ১৯৬০ সালে আই. এ. পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৩ সালে বি. এ. অনার্স ও ১৯৬৪ সালে এম, এ, ডিগ্রি লাভ করেন। উভয় পরীক্ষায়ই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করেন। কলা অনুষদের অন্তর্গত সকল বিভাগের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অনার্স ও সাবসিডিয়ারি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় তিনি নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ব্রিটেনের। সেন্ট এনড্রজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে The Individual and the Absolute শীর্ষক থিসিসের ওপর পিএইচ, ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ড. ইসলাম ১৯৬৫ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন এবং এখনও প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান, কলা। অনুষদের ডীন, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক, সূর্যসেন হলের প্রভােস্ট, গােবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক, এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ-এর সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ দর্শন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। বর্তমানে তিনি উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ দর্শন সমিতির সভাপতি। একজন লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তার কয়েকটি পাঠক। সমাদৃত গ্রন্থ : প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাশ্চাত্য দর্শন, আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, জগৎ জীবন দর্শন, বাঙালির দর্শন; প্রাচীনকাল থেকে সমকাল, নীতিবিজ্ঞান ও মানবজীবন।