"হৃদিতা"বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: হৃদিতা একটা প্রেমের উপন্যাস। এই বইটা আমি খুব যত্ন নিয়ে লিখেছি এবং লিখতে লিখতে এক পর্যায়ে আমার দু'চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করে। আমি প্রথমে চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করি, মনকে বােঝাই, এ-তাে নিছক আমারই বানানাে কাহিনী, কিন্তু চোখের পানি বাঁধ মানে না, তার সঙ্গে শুরু হয় রােদন-ধ্বনি। কী মুশকিল! ভর দুপুরে বাসার লােকজন কম্পিউটারের সামনে বসা একজন লােককে এভাবে কাঁদতে দেখে নির্ঘাত পাগল ভাববে। শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে আমি দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি, দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কেঁদে নিজেকে হালকা করি। সে এক মহাকেলেঙ্কারি কাণ্ড! বললাম বটে যে, এই কাহিনী আমার বানানাে, কিন্তু আমাদের জীবনে এ-রকম ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। এই তাে বছর দুয়েক আগে আমাদের সহকর্মী সুমনা শারমীনের কাছে একটা ফোন এল। ফোন করলেন দেশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি বললেন, আমার ছেলের জন্যে একটা মেয়ে দেখাে, বাঙালি ঘরানার মেয়ে, ছেলে আমার খুবই ভালাে, খুব সুন্দর দেখতে, বিদেশে থাকে, ভালাে চাকরি করে, তবে কথা কি , ছেলে আমার বেশি দিন বাচবে না। সব জেনেশুনে আমার ছেলেকে ভালােবেসে বিয়ে করবে, এ রকম একটা বাঙালি মেয়ে কি পাওয়া যাবে না? | প্রেমের গল্প লেখার সময় আমি লক্ষ্য রাখি, যেন তা একই সঙ্গে জীবনের গল্প আর সম্ভব হলে ফঁাদের গল্প হয়ে ওঠে। মার্কেজ সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, 'মানুষ এক ফাঁদ থেকে আর এক ফাঁদে পা দিচ্ছে, তারপর এক সময় পুরােপুরি আটকে পড়ছে। ইতিহাসের ফাঁদ, অর্থনীতির ফাঁদ, সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদ, ভাগ্যের চাকার ফাঁদ, সম্পূর্ণ নির্দোষের অজানা ফাঁদ- আর সেই বিশাল মহাদেশীয় ফাঁদ যার হাত থেকে নিস্তার নেই আজকের পৃথিবীর কারও।' আমার এ গল্পে ভাগ্যের ফাঁদ আর সম্পূর্ণ নিদোষের অজানা ফাদের পাশাপাশি আরেক ফাদ আছে, স্বরচিত ভালােবাসার ফাদে স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়া। হৃদিতা সাপ্তাহিক ২০০০-এর ঈদসংখ্যা ২০০১-এ বেরিয়েছে, কিন্তু স্থানাভাবে প্রায় অর্ধেকটাই তাতে ছাপা হতে পারেনি। আমি জানি পাঠকেরা সব সময় বড় উপন্যাস চান, প্রকাশকেরাও তাই, কিন্তু পত্রিকা-সম্পাদকেরা খুশি হন ছােটয়। এ বইয়ে পুরােটাই রাখা গেল একসঙ্গে।
আনিসুল হক, বাংলাদেশে গত শতাব্দীর আশির দশকে আবির্ভূত হওয়া একজন প্রখ্যাত কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গদ্যকার্টুন, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে রয়েছে তার সাবলীল বিচরণ। বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক এবং কিশোর আলোর সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। আনিসুল হকের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৪ মার্চ নীলফামারীতে। শিশু মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক বাবার অনুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ জন্মেছিলো লেখালেখি আর ছবি আঁকায়। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন প্রথম কবিতার বই ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। আনিসুল হক এর বই প্রকাশের কালটি ছিলো উত্তাল স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময়। আনিসুল হক এর বই সমূহ প্রেমের প্রতি পক্ষপাত করলেও একইসাথে সেসময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আমি আছি আমার অনলে’, ‘আসলে আয়ুর চেয়ে বড় সাধ তার আকাশ দেখার’, এবং ‘জলরংপদ্য’। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘মা’, আনিসুল হক এর বই সমগ্র এর মধ্যে পাঠকের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল। এছাড়াও ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’, ‘নিধুয়া পাথার’, ‘আয়েশামঙ্গল, খেয়া’, ‘ফাঁদ’, ‘বেকারত্বের দিনগুলিতে প্রেম’, ‘ভালোবাসা আমি তোমার জন্য কাঁদছি’, ‘ফাল্গুন রাতের আঁধারে’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছেন দীর্ঘদিন, এখনও লিখে যাচ্ছেন পত্রিকার কলাম। লিখেছেন বেশ কিছু টেলিভিশন নাটক ও সিনেমার চিত্রনাট্যও। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক এই লেখক।