"পথের পাঁচালী" বইটির ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: পথের পাঁচালীর পুরাে পথই নিসর্গ-প্রকৃতি পরিবেষ্টিত এবং মানব-সংশ্লিষ্ট। প্রকৃতি সাহিত্যের একটি প্রধান উপাদান হয়েছে বিশ্ব জুড়েই। ভিনদেশী উদাহরণ না দিয়েও বলা যায়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, কেবল যদি সংস্কৃতকেই ধরি তবুও, প্রকৃতি এর একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে। কেন, ক্ষুদ্রাবয়বের সেই মেঘদূত? প্রকৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গের কথা না-ই ধরলাম, শুধু মেঘকে বাদ দিলে মেঘদূতে কিছু থাকে? ওটা নামে মেঘ, আসল তা মেঘাকৃতি বিশিষ্ট জীবনের স্পন্দন একটি সচল ও সজীব চরিত্র। সেই কবে কালিদাসের কাল কেটে গেছে সত্যি, কিন্তু জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদার হেরফের হয় নি, বােধহয় হয় না। পৃথিবীর সেই আদি থেকে প্রকতি যেমন মানবজীবনে অবিচ্ছেদ্য ছিল, এখনাে আছে, থাকবে। শুধু এমনিতেই থাকবে না, যেন থাকে সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টাও চলেছে মানুষের। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ ঘােষিত বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলন সে কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অধিকাংশ উপন্যাসেই এই প্রকৃতিকে অবলম্বন করেছেন দৃঢ়ভাবে, নির্মাণ করেছেন একটি পুরাে সত্তাকে। পথের পাঁচালী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগ-সংকটের দিনে প্রকৃতি-প্রীতিতেই তিনি সর্বাধিক মনন ও মেধা ব্যয় করলেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।