"বিশ্ব সাহিত্যের গ্রীক পৌরাণিক গল্প" বইটির লেখকের কথা থেকে নেয়াঃ গ্রীক পৌরাণিক গল্পগুলাে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য গুলির অন্যতম। সেগুলি যে যুগ যুগ ধরে সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা যুগিয়েছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এসব গল্প যে অতি উচ্চমানের, সে কথাও অস্বীকার করা যাবে না। এসব গল্প যারা চিড় করেছিলেন তারা সাধারণ মাপের কোন মানুষ ছিলেন না। তাদের প্রতিভা, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলবে না। মানুষের জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে, জীবনের কঠিন সব সত্যগুলিকে তারা ব্যক্ত করেছিল ঐ সব গল্পগুলির মধ্য দিয়ে। এসব গল্পের আবেদন তাই কোন দিনই শেষ হবে না। চিরদিনই তা মানুষকে নতুন নতুন শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টি করতে উৎসাহ যােগাবে। গ্রীক হেলেনিক সভ্যতার অনেক আগেই এসব গল্পের সৃষ্টি হয়। হেলেনিক গ্রীকদের সুকুমার চিঙ্গুলির অনেকটা জুড়ে আছে এসব গল্প ও কাহিনী। মানুষ তখন যুক্তিতে বিশ্বাস করলেও, অলিম্পােসের দেব দেবীদের প্রতি তখনাে কিছু কিছু মানুষের বিশ্বাস ছিল। ডেলফির এ্যাপােলাের মন্দিরে বা এথেন্সের দেবী এথেনার মন্দিরে তখনাে মানুষের প্রচুর ভীড় হতাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এসে গ্রীক মিথলজির গল্পগুলি পড়ার সুযোেগ পাই। গল্পগুলি আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। গল্পগুলি তাই খুব মনােযােগ দিয়ে পড়ি। যতই পড়ছিলাম, গল্পগুলির অভিনবত্বে ও মানবিক আবেদনে ততই অভিভূত হচ্ছিলাম। গল্পগুলিকে রূপকথার মত মনে হলেও এগুলি কোন রূপকথা ছিল না। রূপকথাকে সব সময় রূপকথা বলেই মনে হয়, সেগুলির পেছনে কোন ইতিহাস বা কোন ধর্মচিল্প নেই। পৌরাণিক গল্পগুলির মধ্যে একদিকে রয়েছে। ধর্মচি, অন্যদিকে ইতিহাসের প্রতি একটা ইংগিত, তাই সেগুলি সত্য বলে বিশ্বাস হয়। রূপকথা ও পৌরাণিক গল্পের মধ্যে এখানেই পার্থক্য। যেমন থীবী, কোরিন্থ, কার্থেজ বা এথেন্স পৌরাণিক গল্পের শহর হলেও, ইতিহাসেও সেগুলি স্থান পেয়েছে। পৌরাণিক গল্পগুলি তাদের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ছাত্রাবস্থায়ই মনে মনে ভেবেছিলাম, এসব গল্পগুলি যদি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা যেতাে, অথবা বাংলায় লেখা যেতাে, বাংলা সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হতাে। দেশের সাহিত্যের ছাত্ররা বা সাহিত্যমােদীরা তা পড়ে আনন্দ পেতাে। যেসব ছাত্ররা ইংরেজি সাহিত্য বা ইউরােপীয় সাহিত্য পড়তে এসে এসব গল্পের চরিত্রেব সম্মুখীন হবে, তারা অবশ্যই এ বই থেকে উপকৃত হবে। ইউরােপীয় সাহিত্যটা ভাল করে বুঝতে হলে, গ্রীক মিথলজির এসব গল্প এবং চরিত্রগুলি জানতে হবে। তাদের পেছনের কথাগুলিও জানতে হবে। কারণ ইউরােপীয় ক্ল্যসিক্যাল সাহিত্যের মূল কাঠামােটা এই গ্রীক মিথলজির উপরই প্রতিষ্ঠিত। শুধু গ্রীক পৌরাণিক গল্পই নয়, অন্যান্য পৌরাণিক গল্পের, যেমন ভারতীয় পুরাণের, প্রতিও আমার গভীর আগ্রহ ছিল। ভারতীয় পুরাণের অনেক গল্পই আমি পড়েছি। ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে গ্রীক পুরাণের একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে। এ মিল আমাকে গ্রীক পুরাণের প্রতি আরাে বেশি আগ্রহী করে তুলে। ভারতীয় মহাকাব্যের (রামায়ণ ও মহাভারত) গল্পগুলির সঙ্গে তাই গ্রীক পুরাণকে বা গ্রীক মহাকাব্যের ঘটনাগুলিকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। মিথলজির বা পুরাণের উপর যেসব বই হাতের কাছে। পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গেই তা সংগ্রহ করেছি। এতদিন বইটি লেখার সুযােগ করে উঠতে পারিনি। তার বড় কারণ ছিল, আমার নানাবিধ কর্মব্যস্তা। এমন সব কাজে ব্যন্ডু থাকতে হতাে, যেখানে এ ধরনের লেখালেখির কোন সুযােগ বা সময় ছিল। এবার শিক্ষকতা করতে এসে লেখার সুযোেগটি পেয়ে গেলাম। মিথলজির প্রতি কিছু কিছু ছাত্রের আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে আমি আরাে উৎসাহিত হয়েছিলাম। বইটিতে মিথলজি তথা পৌরাণিক গল্পের একটা সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছি এবং গল্পগুলি কবে এবং কিভাবে আমাদের নিকট আসলাে, সেকথাও বলার চেষ্টা করেছি। পৌরাণিক গল্পকারগণ তাদের নিজেদের ইচ্ছামত বিশ্ব ও মানুষ সৃষ্টি, পৃথিবী বা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সে ধারণার কথা সংক্ষেপে বলেছি। অলিম্পাসের দেবতাদের পরিচয়, তাদের দায়িত্ব, পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, তাদের বিচিত্র সব কাজ কর্ম সম্পর্কেও বলা হয়েছে। গ্রীক মিথলজিতে আমরা কয়েকটি রাজবংশের উল্লেখ পাই। সেগুলি গল্প হলেও তাদের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। এদের মধ্যে থীবীর রাজবংশ, এথেন্সের রাজবংশ এবং ট্যানটালাসের অভিশপ্ত বংশই উল্লেখযোগ্য। এসব রাজবংশের নানা ঘটনা, দেবতাদের সঙ্গে মানুষের ঝগড়া বিবাদ, দেবতাদের শাড়ি, সে শাড়ি থেকে মুক্তি ইত্যাদি ঘটনাগুলি বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাচীন লােকদের কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প যেমন আটালান্টার বন্য বরাহ শিকার বা হত্যা, জেশানের গােল্ডেন ফ্লীসের সন্ধানে অভিযান, থীবীর বিরদ্ধে সাত জনের অভিযান প্রভৃতি গল্পগুলি সংক্ষেপে বলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অনবদ্য প্রেমের গল্প যা চিরদিনই মানুষকে আনন্দ দেবে, যেমন পিগমেলিয়ন ও গালাটিয়ার গল্প, অরফিউস ও ইউডিসের গল্প এমনি আরাে কয়েকটি গল্প বইটিতে বলা হয়েছে। মিথলজির গল্পগুলিতে ইতিহাস নির্মাণের অনেক উপাদান থাকে। আমরা লক্ষ করি এথেন্সের রাজা থিসিউস এথেন্সে যে প্রজাতন্ত্র আরম্ভ করেছিল বলে গল্পে উলে-খ আছে, পরবর্তী সময়ে আমরা তা এথন্সে তথা গ্রীসে লক্ষ করেছি। পৌরাণিক এসব গল্প অজানা অতীত ও ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়। হেলেনিক সভ্যতার সময় গ্রীক মিথলজির গল্পগুলি আরাে পরিশীলিত হয় এবং সেসব গল্প ও কাহিনীকে উপজীব্য করেই সৃষ্টি হয় কালজয়ী সব সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। কবি হােমার ও ভার্জিল এসব গল্পকে উপজীব্য করেই লিখেছিলেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ইলিয়াড, ওডিসি ও ইনিড। এই গল্পগুলিকে নিয়েই ইস্কিলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস ও সেনেকার মত নাট্যকারগণ লিখেছেন কিং আগামেমনা, কিং ইডিপাস, মিডিয়া, ফেড্রার মত কালজয়ী সব নাটক। বিশ্বমাপের এসব সাহিত্য সৃষ্টির মূল ভিতটাই স্থাপিত হয়েছিল মিথলজির গল্পের উপর। হােমার তার ইলিয়াডের মধ্য দিয়েই ইউরােপীয় সাহিত্যের একটা অবয়ব দিয়ে গেছেন। ইউরােপের সব সাহিত্যই তার নিকট থেকে প্রেরণা এবং কাঠামােগত একটা রূপ পেয়েছে। কিং ইডিপাস সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ট ট্র্যাজেডি হিসেবে আজ বিবেচিত। হিসড (Hesiod), হােরেস (Horace) বা ওভিড (Ovid) দেবতার প্রশড়ি গেয়ে যে সব কবিতা লিখেছিলেন সেগুলি আজো শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা হিসেবে সমাদৃত। দাড়ে ও মিলটন তাদের পাতালপুরী বা নরকের ধারণা তাে হােমারের নিকট থেকেই নেয়া। আধুনিক ইংরেজ কবি টেনিসন, শেলী বা কীটস সবাই তাে গ্রীক মিথলজির গল্পগুলি নিয়েই তাদের সুন্দর সুন্দর কবিতাগুলি লিখেছেন। রেনেসার (Renaissance) পর ইউরােপীয় কবি সাহিত্যিকগণ হঠাৎ করেই যেন গ্রীক মিথলজিকে নতুন করে আবিষ্কার করলাে। মিথলজির গল্পগুলি থেকে যে ইউরােপীয় সাহিত্য, ভাস্কার্য (ভেনাস ও এ্যাপােলাের মুর্তি ও অন্য সব শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রেরণা এসেছে, সে কথা বলাটা হয়তাে একটুও অত্যুক্তি হবে না। আধুনিক লেখকদের নিকট ইউলিসিস এখনাে একটি অতি প্রিয় নাম। ইউলিসিস চরিত্রটাকে তারা নতুন করে আবিষ্কার করতে চায়। ইউরােপের এমন কোন সাহিত্য নেই, যেখানে এসব গল্পগুলির প্রভাব পড়েনি। ভবিষ্যতে এগুলি নিয়ে যে আরাে নতুন নতুন সাহিত্য ও শিল্পকর্ম সৃষ্টি হবে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। বইটি লিখতে আমি অনেকগুলি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি। তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় এডিথ হ্যামিলটনের মিথলজি (Mythology : Edith Hamilton) বইটির কথা। হ্যামিলটনের বইটি সম্মুখে রেখেই আমি বইটি লিখেছি। অনেকে হয়তাে বলতে পারেন, আমি বইটির ভাবানুবাদ করেছি। আসলে তা নয়। বিষয় এবং ঘটনাগুলি হ্যামিলটনের নিকট থেকে নিলেও লিখেছি আমার নিজের মত করে এবং আমার নিজের ভাষায়। অন্য যেসব বই থেকে সাহায্য নিয়েছি, তাদের মধ্যে রবার্ট গ্রেভস (Robert Graves)- এর দি গ্রীক মিথস (The Greek Myths : Vol. I