প্রথম ফ্ল্যাপ এর লেখা: তখন তরুণরচনার অগ্নিময় মশাল, 'কৃত্তিবাস'; তরুণ লেখকের সৃজন-সত্তার সার্থক স্বীকৃতি বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা'। আর এই দুই পত্রিকাতে প্রায় একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়ে বাংলা কবিতার আসর চমকে দিয়ে আবির্ভূত হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। 'কোনও প্রেরণা নয়, কোনও সনির্বন্ধ ভালোবাসায় না-শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে এইসব পদ্য লেখা': নিজেই জনিয়েছেন তিনি। প্রথম থেকেই তিনি চমকপ্রদ। কিংবদন্তীপ্রতিম জীবনযাপন, বেপরোয়া, ভূক্ষেপহীন। কিংবদন্তী হয়ে-ওঠা একেকটি কবিতা। সতেজ, সবল, স্বেচ্ছাচারী। কখনও শব্দের প্রভু তিনি, কখনও পূজারী। ছন্দে-ছন্দোহীনতায়, মিলে-মিলহীনতায়, কোলাহলে-স্বগতোক্তিতে, উপমায়-সরলতায়, শৃঙ্খলায়-উচ্ছৃঙ্খলতায় সমান প্রবল তিনি। সম্পন্ন, প্রাচুর্যময়। কিন্তু সবসময়ই অভাবনীয়। অজস্র লিখেছেন, কিন্তু কবিতাই লিখেছেন। যদিও নিজে বলেন, পদ্য। এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরই যাবতীয় কাব্যগ্রন্থ নিয়ে খণ্ডে-খণ্ডে বেরুচ্ছে 'পদ্য-সমগ্র'। শুরু সেই প্রথম থেকে। এই প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ছটি কাব্যগ্রন্থ: হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য ধর্মে আছো জিরাফেও আছো; অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে; চতুর্দশপদী কবিতাবলী হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান এবং উড়ন্ত সিংহাসন। কীভাবে ভাঙতে-ভাঙতে এগোচ্ছেন এ-যুগের এক অন্যতম প্রধান কবি, কীভাবে সব লণ্ডভণ্ড করেও কুড়িয়ে নিচ্ছেন সবিস্ময় ভালোবাসা, কীভাবে বদলে যাচ্ছে উপমা ও চিত্রকল্পের ধরন, শব্দের ব্যবহার এবং ছন্দ-মিলের পরীক্ষা, কীভাবে মৃত্যু ও জীবনের অমোঘ টানাপোড়েনে ফুটে উঠছে উচ্চারণের নকশা-তারই এক জীবন্ত ও অনুপম চলচ্ছবি যেন কালানুক্রমিক এই কাব্যগ্রন্থাবলী।
জন্ম: নভেম্বর ২৫, ১৯৩৪ সালে জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি। বাঙালি-ভারতীয় এই কবি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ এর জয়নগর - মজিলপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার কাশিমবাজার স্কুলে পড়তেন। দারিদ্রের কারণে তিনি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। কলেজজীবনে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার উপন্যাস অবনী বাড়ি আছো? দাঁড়াবার জায়গা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে অনেক ফিচার লিখেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। ১৯৭০ - ১৯৯৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেছেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলন - এর জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সহ তিনি একাধিক পুরস্কারে সন্মানিত । তিনি মার্চ ২৩, ১৯৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।