শ্রীচৈতন্যের দিব্যজীবন ও অজ্ঞাত তিরোধান পর্ব ভূমিকা
ডক্টর শ্রীযুক্ত বিষ্ণুপদ পাওা বাংলা গবেষণাসাহিত্যে অতি সুপরিচিত, অব পরিশ্রম ও পাণ্ডিত্য উড়িষ্যার গবেষক ও বিদগ্ধ পণ্ডিতরাও বিশেষভাবে প্রশংসা করে থাকেন। ড. পাণ্ডা দীর্ঘকাল ভুবনেশ্বরে বাস করে, ওড়িয়া, ভাষা প্ৰায় মাতৃভাষার মতো আয়ত্ত করেছেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল ওড়িয়া হরফে লেখা বাংলা কাব্য, যেগুলি ভুবনেশ্বর প্রদর্শশালা থেকে পাওয়া গেছে। একদা উড়িষ্যা বা বাংলাদেশ একই শাখায় দুটি ফুলের মতো বিকশিত হয়েছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনের শেষার্ধ পুরীধামে অতিবাহিত হয়েছে। উড়িষ্যার ধনী অভিজাত, রাজা ও দীনদরিদ্র সকলেই তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। উড়িষ্যা ও বাংলার তাঁর দ্বারাই দৃঢ়ত্ব লাভ করেছেন । শ্রীজগন্নাথের পুণ্যভূমি নীলার ভ্রাতৃত্ববন্ধন শ্রেষ্ঠ তীর্থ। সুতরাং বাঙালির সঙ্গে উড়িষ্যার সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। অনেক বাঙালি তীর্থ দর্শনে গিয়ে উড়িষ্যায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন, কেউ বা কর্মব্যপদেশে বাস্তু বেঁধেছেন। অনেক বাঙালি উড়িষ্যায় বসবাস করে ওড়িয়া ভাষাকে মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করেছেন, কেউ কেউ ওড়িয়া ভাষায় কাব্য রচনা করে ওড়িয়া সাহিত্যকে ঐশ্বর্যশালী করেছেন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় পর্যন্ত বহু বাঙালি ওড়িয়া সাহিত্যের বিকাশে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। রঙ্গলাল উড়িষ্যায় প্রথম সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন। ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে' তিনি ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর ‘কাঞ্চীকাবেরী’ প্রাচীন ওড়িয়া কবি মাগুনি দাসের প্রেম-ভক্তি ও ঐতিহাসিক কাব্য অবলম্বনে রচিত। সুতরাং বাংলা ও উড়িষ্যা শুধু প্রতিবেশী নয়, একের সঙ্গে অপরের গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক। ড.শ্রীযুক্ত বিষ্ণুপদ পাণ্ডা সেই আত্মীয়তার সূত্রে আরো কয়েকটি সূত্র সংযোজনা করে উভয় ভাষার নৈকট্য সাধন করেছেন। বক্ষ্যমান পুস্তিকাটিতে ড. পাণ্ডা শ্রীচৈতন্যদেব ও নীলাচলভক্তসম্প্রদায় সম্বন্ধে যে তথ্য উপস্থাপিত করেছেন তার ফলে সমগ্র চৈতন্যজীবনকথাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন। একালে যাকে জীবনী বলা হয়, অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের বাস্তব জীবনকথা—প্রাচীন ও মধ্যযুগে তাকে বলা হত জীবন-চরিত, অর্থাৎ কোনো মহাপুরুষের দিব্যজীবনকথা। বাস্তব জীবন ও দিব্যজীবনের মধ্যে ‘বহুত অন্তর’। সুতরাং hagiography থেকে bio-graphy -র নিরেট বাস্তব সত্য আশা করা যায় না। তাই মধ্যযুগে বাংলাদেশে সংস্কৃত ও বাংলায় যে সমস্ত চৈতন্য চরিতকাব্য লেখা হয়েছে তাতে প্রতিদিনের বাস্তব ঘটনার বাহুল্য নেই। শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি ফোটাতেই গৌড়ীয় ভক্তেরা বেশি উদ্গ্রীব ছিলেন। নীলাচলে মহাপ্রভুর জীবনের শেষার্ধ অতিবাহিত হয়েছে। উড়িষ্যার সর্বশ্রেণীর মানুষ তাঁকে ঈশ্বরজ্ঞানে ভক্তি করতেন, শ্রীচৈতন্যদেবও তাঁর ওড়িয়া ভক্তদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ফলে তাঁর গৌড়ীয় ভক্তেরা অভিমানে পুরীধাম ত্যাগ করে গৌড়ে প্রত্যাবর্তন করেন। এসব কৌতূহলজনক ব্যাপার একালের গবেষকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর করে তুলবে। পুরীর ওড়িয়া ভক্ত এবং গৌড়ীয় ভক্তদের সম্পর্ক, বিবাদ, মনোমালিন্যের কারণ ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। সেই আলোচনার দ্বার উন্মোচন করলেন ড. পাণ্ডা। শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক মাধব পট্টনায়ক নামে চৈতন্যভক্ত ওড়িয়া কবি মহাপ্রভুকে অত্যন্ত নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মাধব দু'খানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, ‘চৈতন্যবিলাস' (১৫১৬ খ্রীঃ অঃ) এবং ‘বৈষ্ণবলীলামৃত’ (১৫৩৫ খ্রীঃ অঃ)। শ্রীচৈতন্য সম্পর্কিত তথ্যবিচার, তত্ত্বনির্ণয় ও শ্রীচৈতন্য প্রচারিত সাধ্যসাধনতত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে এই দুখানি ওড়িয়া কাব্য বিশেষ প্রয়োজন। গৌড়ীয় গ্রন্থে যেখানে ফাঁক আছে, এই দুই ওড়িয়া গ্রন্থ অবলম্বন করে সে শূন্যতা পুরিয়ে দেওয়া চলে। তার প্রধানতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মহাপ্রভুর তিরোধান। বঙ্গীয় প্রামাণিক চৈতন্য-জীবনকাব্যে এ-বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। তাঁর মর্ত্যকায়া ত্যাগের ঘটনাটিকে জয়ানন্দ বাস্তব ও স্বাভাবিক ভাবেই বর্ণনা করেছেন, তাই কোনো কোনো ভক্ত জয়ানন্দ-পরিবেশিত তথ্যকে প্রামাণিক বলে মানতে চান না। কিন্তু এই ঘটনাকে ওড়িয়া ভক্তকবি মাধব পট্টনায়ক যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের ঘটনাকে আবার নতুনভাবে পর্যালোচনা প্রয়োজন। এই আলোচনায় ড.পাণ্ডা সমস্ত তথ্য প্রমাণ উপস্থিত করে সমস্যার যুক্তিপূর্ণ সমাধান করতে চেয়েছেন। বলাই বাহুল্য এসব ধর্মীয় ব্যাপারে কখনো ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু যুক্তিকে যদি ভক্তির চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে বিষ্ণুবাবুর অভিমত যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা উচিত। আমাদের বিশ্বাস, তাঁর আলোচনা পণ্ডিত, গবেষক ও ভক্তদের নানা দিক থেকে সচেতন করে তুলবে। সত্যনির্ধারণ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। সেদিক থেকে শ্রীচৈতন্যদেবের শেষজীবন সম্বন্ধে ড. পাণ্ডা কয়েকটি নতুন সমস্যা ও তার সমাধানের সূত্র নির্দেশ করেছেন। বাংলা ও উড়িষ্যার বিদ্বজ্জন এ-বিষয়ে যথেষ্ট কৌতূহলী হবেন তাতে সন্দেহ নেই। গ্রন্থটির বহুল প্রচার একান্ত কাম্য ।