"পূর্ববাংলার সমাজ ও রাজনীতি" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ অতিশয়ােক্তি হবে না যদি বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু। পাঠক বা ছাত্রের জন্য কামরুদ্দীন আহমদের A Socio Political History of Bengal বা তার বঙ্গানুবাদ পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। বিশ শতকের শুরু থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এতদৃঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ আর লিখিত হয়নি বললেই চলে। যে কাল-খণ্ডটিকে লেখক এখানে উপস্থাপন করেছেন বহুলাংশে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী, অনেক ঘটনার সাক্ষী, এমনকি শরিকও। বর্ণনার পাশাপাশি নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ঘটনার মূল্যায়ন বা বিচার-বিশ্লেষণও করেছেন। তবে লেখকের মতামত বা সিদ্ধান্ত কোথাও রচনার বস্তুনিষ্ঠতাকে ক্ষুন্ন করেনি। গতানুগতিক বা অন্যান্য ছাত্রপাঠ্য ইতিহাস পুস্তকের সঙ্গে তুলনায় এ-বইটিকে যা বিশিষ্টতা দিয়েছে তা হল লেখকের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সমগ্রতাবােধ। লেখকের নিজের কথায় “আমি চর্চিত-চর্বণ করিনি। আমি নভােচারীর মত চাঁদের উল্টো দিকের রূপ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেছি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাদ সম্বন্ধে যা লেখা হয়েছে তার সাথে নভােচারীদের দেখা চাঁদের চেহারার কোন মিল নেই বলেই নভােচারীদের দেখা চাঁদ মিথ্যে আর যারা চাঁদ সম্বন্ধে কল্পনার ফানুস এঁকেছেন তাদের কথা সত্য—একথা বলা যায় না।” সকল শ্রেণীর পাঠককে যা অতিরিক্ত আকর্ষণ করবে তা হল লেখকের সরল, নিরলঙ্কার ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি। মাঝে দীর্ঘদিন অমুদ্রিত থাকার পর বইটির এই পুনঃপ্রকাশ রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ও আগ্রহী পাঠকদের এক বড় অভাব পূরণ করতে পারবে বলে আমরা আশা করি।
কামরুদ্দীন আহমদ জন্ম ১৯১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করেন। কর্মজীবনের শুরুতে কিছুকাল ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে আইন পেশায় যােগ দেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গণআজাদী লীগ গঠনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগে যােগ দেন ও পরের বছর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রথমে কলকাতায় পাকিস্তানে হাইকমিশনার ও পরে বার্মায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। শ্রমিক আন্দোলনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারাবন্দী করে রাখে। তার স্মৃতিকথা ও অন্যান্য গ্রন্থ এ দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার মূল্যবান উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।