"বাঙ্গালীর ইতিহাস" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: এটি বাংলার প্রাচীন ইতিবৃত্তবিষয়ক শেষ বই এবং বাঙালির ইতিবৃত্ত সাধনার চরম পরিণতিও ঘটেছে এটিতেই।... বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, আলােচনার বিস্তারে এবং দৃষ্টির গভীরতায় আর কোনাে বই-এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। উইলকিনস-জোনস-কোলব্রক-প্রমুখ বিদেশী মনস্বীদের জ্ঞানাভিযান, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা, রাজেন্দ্রলালহরপ্রসাদের গবেষণা এবং অক্ষয়কুমার-রাখালদাস-রমেশচন্দ্র প্রভৃতির সাধনার ফল পরিণতি লাভ করেছে নীহাররঞ্জনের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাসে। বস্তুত, এই মহাগ্রন্থখানি বাংলার পুরাবৃত্তচর্চার ইতিহাসে একটি মহাযুগের অবসান এবং আর-একটি মহাযুগের আবির্ভাবের সূচনাস্থান।.. বিংশ শতকের বিগত অর্ধ ছিল বাংলার পুরাবৃত্তচর্চার যুগ এবং তার আগামী অর্ধ হবে ইতিহাসচর্চার যুগ। তাই দুই যুগের সন্ধিস্থলেই হচ্ছে ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থখানির স্থান। শেষ পুরাবৃত্তকার হিসাবে নীহাররঞ্জন যে মর্যাদারই অধিকারী হন না কেন, প্রাচীন বাংলার প্রথম ঐতিহাসিক হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। পুরাবৃত্তকারের মতাে তিনি শুধু তথ্য-সন্নিবেশ ও ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দান করেই নিরস্ত হননি, তিনি প্রত্যেকটি তথ্য ও ঘটনার তাৎপর্য নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন, বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার মধ্যে কার্যকারণসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এখানেই ইতিবৃত্তের সঙ্গে ইতিহাসের পার্থক্য এবং এটাই ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ এর বিশেষ গৌরব।.. বাঙালির সদ্যোজাগ্রত ঐতিহাসিক চেতনাকে আমি বিশ্বাস করি আর এই চেতনাকে উদ্বুদ্ধ ও সক্রিয় করে তােলবার ব্যাপারে বাঙ্গালীর ইতিহাসের দান অন্য কোনাে গ্রন্থের চেয়ে কম নয়, সুতরাং এটাও আশা করি যে, এই নব-সচেতন বাঙালির মন। গ্রন্থকারকে পুনঃপুনঃ বাঙ্গালীর ইতিহাসের নূতন নূতন সংস্করণ প্রকাশের সুযােগ দেবে।
নীহাররঞ্জন রায় (জন্ম : ১৪ই জানুয়ারি, ১৯০৩ - মৃত্যু : ৩০শে আগস্ট, ১৯৮১)। তাঁর পিতার নাম মহেন্দ্রচন্দ্র রায়। তিনি মণিকা রায় নামীয় এক রমণীকে বিয়ে করেন। রায় দম্পতির সংসারে দুই পুত্র এবং এক কন্যা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ময়মনসিংহে সম্পন্ন হয়। সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ বি.এ পাস করেন ১৯২৪ সালে। পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৬ সালে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের শিল্পকলা শাখায় এম.এ পাস করে রেকর্ড মার্ক-সহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯২৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ ফেলো হিসাবে নিযুক্ত হয়ে গবেষণায় ব্রতী হন। বৃত্তি নিয়ে ১৯৩৫ সালে ইউরোপ যান এবং হল্যান্ড-এর লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি এবং লন্ডন থেকে গ্রন্থাগার পরিচালনা বিষয়ে ডিপ্লোমা নেন। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে শিল্পকলা বিষয়ে রানী বাগেশ্বরী অধ্যাপক পদে বৃত হন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণের পর ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাঁকে প্রফেসর এমিরেটস করা হয়। সিমলায় প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক হয়ে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ঐ পদ অলঙ্কৃত করে ছিলেন। ইউনেস্কো-এর প্রতিনিধিরূপে ব্রহ্মদেশ সরকারের সংস্কৃতি ও ইতিহাস-বিষয়ক উপদেশক ছিলেন ১৯৭৩-৭৬ সাল পর্যন্ত। এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে -- লাইব্রেরি অ্যাসোশিয়েশন অফ গ্রেট ব্রিটেন, লন্ডন; রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ গ্রেট ব্রিটেন, লন্ডন; রয়েল সোসাইটি অফ আর্টস, লন্ডন; ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন অফ আর্টস, জুরিখ; এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা'র ফেলো নির্বাচিত হন। ছাত্রবস্থা থেকেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। এক সময়ে রাজনীতি ও সাংবাদিকতা করেছেন : আকৃষ্ট হয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির প্রতি, অসহযোগ আন্দোলন-এ অংশ নিয়েছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি লিবার্টি পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ পরিচালনা করেছেন। আর এস পি (রিভ্যলুশনারী সোশ্যালিস্ট পার্টি) দলের সঙ্গে যুক্ত হন এবং দলের মুখপত্র ক্রান্তির পরিচালনা মণ্ডলীতে ছিলেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলন-এ অংশ নেওয়ায় কারাবরণ করেন। তিনি ছিলেন বাঙালি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা-গবেষক পন্ডিত। দেশবরেণ্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনীষী ছিলেন তিনি।