"বাংলার বারোভুঁইয়া এবং মহারাজ প্রতাপাদিত্য" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ষােড়শ শতকের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস নানান ঘটনায় জটিলতাপূর্ণ। পাঠান শাসকবর্গের সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতা-প্রেমী রাজন্যবর্গের যােগসূত্র গড়ে ওঠায় মােঘল সম্রাট আকবরের পক্ষে সমগ্র বাংলা অধিকার ছিল দুঃসাধ্য। বারবার মােঘল শাসনকর্তার পরিবর্তন ঘটিয়েও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। এই সময়ে বাংলার স্বাধীন দুর্ধর্ষ বারােভূঁইয়াদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানান কিংবদন্তী। সেইসব কিংবদন্তীর সঙ্গে ইতিহাসের উপাদানের মিশ্রণ ঘটিয়ে যে ঘটনাপঞ্জীর উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে, তার সবটুকু গ্রহণযােগ্য নয়। ইতিহাস হিসাবে মেনে নেওয়াও কঠিন। এই বারােভূঁইয়াদের সংখ্যা কখনও বারাে, কখনও বা তার কম বা বেশি, দেখা গেছে বারবার। বারােভূঁইয়াদের রাজ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে উড়িষ্যা সীমান্ত পর্যন্ত। ঐতিহাসিকদের মধ্যে অধিকাংশেরই অভিমত “বারাের্ভুইয়া” কোন নির্দিষ্ট সংখ্যাবাচক নয়। ছােট-বড় ভূস্বামী বা জমিদাররা তাদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলের সর্বময় কর্তা ছিল। তারাই রাজস্ব সংগ্রহ করত। স্থানীয় জনগণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিল তারাই। যােড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় পাঠান রাজত্বের অবসানকালে এবং মােঘল আধিপত্য বিস্তারের সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল এরকম ভূস্বামীদের আধিপত্য। ভূস্বামীরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষায় ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মােঘল রাজশক্তিকে তারা কখনও মেনে নেয়নি। ছােট বড় অনেক জমিদারের অধীনে থাকায় সেই সময়কে বলা হত বারােভূঁইয়ার আমল। আসাম প্রদেশেও সেসময়ে ছিল বারােভূঁইয়ার আধিপত্য। দুর্গাচন্দ্র সান্যাল আসামের বারােভূঁইয়ার বিবরণ দিয়েছেন। তারপর তিনি বাংলার বারােভূঁইয়াদের কথা বলেছেন। কিন্তু কৈলাসচন্দ্র সিংহ বলেছেন—আকবরের জন্মের আগে, পাঠান শাসনকালে বাংলাদেশ দ্বাদশভাগে বিভক্ত ছিল। এইসব বিভাগের জমিদারদের “ভৌমিক” বা “ভুঞা” বা “ভূঁইয়া” বলা হত। তারা রাজা বা রায় উপাধিগ্রহণ করতেন। এরা ছিলেন স্বাধীন। তাদের দুর্গ, সৈন্য আর নৌবাহিনী ছিল। জলে-স্থলে তাদের বিক্রম কম ছিল না। দুর্গাচন্দ্র সান্যাল “বাংলার সামাজিক ইতিহাসে” বারােভূঁইয়া আলােচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, পাঠান রাজত্বকালে রাজধানী থেকে দূরবর্তী স্থানের ভূঁইয়ারা নবাবকে সামান্য রাজস্ব দিয়ে কার্যত স্বাধীন থাকত এবং পার্শ্ববর্তী ভূঁইয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। সেকারণে তাদের ভাগ্যও পরিবর্তিত হত। একজন অপরের অধীন এলাকা দখল করে নিজের পরাক্রম বৃদ্ধি করত। এক বছর যারা বারােভূঁইয়া থাকত, পরবর্তী বছরে তাদের কেউ কেউ আবার অন্যের দখলে চলে যেত। অথবা, নতুন বছরে নতুন ভূঁইয়া পরাক্রমশালী হয়ে উঠত। কোন বছর বারাে, কোন বছর আট, কোন বছর যােল এরকম হ্রাস বৃদ্ধি হত। শ্ৰীসান্যাল লিখেছেন : “বাংলাদেশের প্রচলিত প্রবাদে যে “বারাের্ভুইয়া” শব্দটি কথিত হয়, তাহা বােধ হয় “বড় ভূঁইয়া” শব্দের অপভ্রংশ। কেননা পূর্বে জমিদার মাত্রে সকলকেই ভূঁইয়া বলা হইত। সুতরাং শত সহস্র ভূঁইয়া ছিল। আর প্রধান প্রধান ভূঁইয়া যাহারা প্রায় স্বাধীন নৃপতির তুল্য ছিলেন, তাহাদের সংখ্যা সর্বদা সমান থাকিত না। সময়ে সময়ে নয়জন হইতে ষােল জন পর্যন্ত হইত। সুতরাং তাহাদিগকে “বারােভূঁইয়া” না বলিয়া “বড় ভুইয়া” বলিলেই ঠিক অর্থ হয়। বিশ্বকোষ অভিধানে এ বিষয়ে আর একটি প্রমাণ আছে— “কামতাপুরে দুর্লভনারায়ণ রাজার সময়ে ঐ রাজ্যে বিস্তর বিশৃঙ্খলা ও অশাসন হয়। রাজার বন্ধু গৌড়েশ্বর কামতাপুর রাজ্য সুশাসন সংস্থাপন জন্য সাতটি সুযােগ্য ব্রাহ্মণ এবং সাতটি সুযােগ্য কায়স্থ কর্মচারী পাঠাইয়াছিলেন। সেই চৌদ্দজন বিজ্ঞলােক ঐ রাজ্যে সুশাসন ও শান্তি স্থাপন করিয়াছিলেন। রাজা তাহাদের যােগ্য দৃষ্টে তাহাদিগকে প্রচুর ভূসম্পত্তি দিয়া নিজ রাজ্য মধ্যে নিবিষ্ট করিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে “বারাে ভূঁইয়া” উপাধি দিয়াছিলেন।
Sreekedarnath Mojumdar ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যেষ্ঠ (ইংরেজি ১৮৭০) কিশোরগঞ্জ জেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম লোকনাথ মজুমদার ও মাতার নাম জয়দুর্গা দেবী। কেদারনাথ মজুমদারের পড়ালেখা শুরু হয় তার নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি ময়মনসিংহ শহরে যান। সেখানে তিনি নাসিরাবাদ এক্টাস স্কুলে ভর্তি হন। পরে ময়মনসিংহ শহর বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৮৪ সালে তিনি ময়মনসিংহ জিলা বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হন। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৮৮৯ সালে এট্রাস পাশ করেন। পরিবার চালানোর জন্য তিনি ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্টেট অফিসের ফৌজদারি থানায় নকলনবীশের চাকরি নেন। তার মামা কৃষ্ণকুমার রায় তাকে এ চাকরিটির ব্যবস্থা করে দেন। এই চাকরির উপর নির্ভর করে তিনি সাহিত্য চর্চাও করেছেন। সাহিত্য চর্চার খরচ যোগানের জন্য চাকরির পাশাপাশি পাঠ্য বই প্রণয়ন মানচিত্র প্রকাশ ও ছাপখানা পরিচালনা ইত্যাদি কাজ করেছেন। চাকরি জীবনে তিনি একসময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯০১ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তার সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয় তার নিজ বাড়ি থেকেই। তার বাবা-মার অনুপ্রেরণা থেকে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হন। নাসিরাবাদ বিদ্যালয়ের প্রধান পণ্ডিত বেদজ্ঞ উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে শাস্ত্র ও পুরাণনুশীলনে আগ্রহী হন। ময়মনসিংহ জিলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীনাথ চন্দ্র তাকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জাগান। তিনি ময়মনসিংহ জিলা বিদ্যালয়ে 'মনোরঞ্জিকা ক্লাব'-এ সাহিত্য চর্চা করতেন।বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি তার প্রথম উপন্যাস 'স্রোতের ফুল' রচনা করেন। চাকরি অবস্থায় নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েও তিনি সাহিত্যচর্চা করেন। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্য কলকাতা যান। সেখানেও তিনি সাহিত্য চর্চা করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন রকমের দুস্রাপ্য গ্রন্থ পাঠ সংগ্রহ করতেন ও হাতে লিখে নিতেন। কেদার নাথ মজুমদার একাধিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। সম্পাদকতার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। কেদারনাথ মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে ময়মনসিংহ শহরে ১৯১৭ সালে ‘জয়দুর্গা এম.ই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তী সময়ে হাইস্কুলে উন্নীত হয় এবং ‘জয়দুর্গা ইনস্টিটিউশন’ নামে পরিচিত হয়। এ ছাড়া তিনি মায়ের নামে নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগে ময়মনসিংহ শহরে ‘সাহিত্য সভা’ স্থাপিত হয়। তিনি 'ময়মনসিংহরে ইতিহাস' নামে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন যা একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯০৪ সালে 'ময়মনসিংহের বিবরণ' প্রকাশ করেন এবং ১৯০৭ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। ময়মনসিংহরে ইতিহাস' ও ময়মনসিংহরের বিবরণ" রচনা করে তিনি ইতিহাসবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহের কাহিনী ও ময়মনসিংহ পল্লী বিবরণ নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি 'ঢাকার বিবরণ' রচনা করেন। এছাড়া তিনি 'ফরিদপুরের বিবরণ' নামেও একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯১৫ সালে 'সারমত কুণ্ডা' নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি জীবনে চারটি ডপন্যাস রচনা করেছিলেন। বিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় ১৮৮৮ সালে স্রোতের ফুল উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে তা প্রফুল্ল নামে প্রকাশ করেন। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে তিনি শুভদৃষ্টি উপন্যাস এবং ১৩৩১ বঙ্গাব্দে ‘সমস্যা’ উপন্যাস প্রকাশ করেন। তিনি 'দস্যুর মহত্ত্ব', 'স্বপ্ন' ও 'ঋণ পরিশোধ' নামে তিনটি ক্ষুদ্র উপন্যাসও লিখছিলেন ও এই তিনটি উপন্যাসকে একত্র করে ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে 'চিত্র' নামের একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস প্রকাশ করেন।