"প্রথমাদের জন্য" বইয়ের কিছু অংশবিশেষ প্রথমা তো কতবারই বলেছে, একবার আসবেন, সত্যি একবার আসবেন। খুব খুশী হব, দেখবেন কত আদর করব আপনাকে। আর কেউ না জানুক, অরু জানে যে জীবনে যা হারিয়ে যায় সে আর ফিরে পাওয়া যায় না। হয়তাে কেউই চায় না তবু বেদনা জেগে থাকে, যাদের হৃদয় থাকে তাদের হৃদয়ে। সমস্ত কিছু পেয়েও একজনকে না-পাওয়ার বেদনা, সমস্ত প্রাপ্তিকে মিথ্যা করে অনুক্ষণ তার সমস্ত হৃদয় আচ্ছন্ন করে থাকে। একজন পুরুষের সব যশ, সব অথ, সব সাম্রাজ্য স্নান করে তার সাফল্যের সবোচ্চ শিখরের উপরের আকাশে একজনের মুখ, একজনের হাসি, একজনের চোখের উজ্জলতা ঝিলিক মেরে যায়। তখন কেন জানি না, মনে হয় সব মিথ্যা, সব ফাঁকি, সব পাওয়া তার বৃথা হয়ে গেল। .. এ ভাবনা শুধু, পুরুষের জন্যে। মেয়েরা এ ভাবনার কোন দাম দেয় না। ওরা এমন গভীরভাবে ভাবতে শেখেনি। জীবনের একটা সময় অবধি ওরা দু হাত দিয়ে শরীরটাকে আড়াল করে রাখে, শরীরে হাত ছোঁওয়াতে গেলে বলে, না, না, না। তারপর সমাজ এবং সংস্কারের বশে সে যাকে পতিরুপে বরণ করে, তাকে তার অদেয় যা ছিল তা উজাড় করে দেয়। একদিন যা দূর্মূল্য ছিল তা সেদিন সস্তা হয়ে যায়। একদিন যা মহার্ঘ ছিল, দৈনন্দিনতার কলুষ পরশে তা অতি বাজে ও মূল্যহীন হয়ে যায়। বিয়ের পর মেয়েরা তাদের ঘর, তাদের চুল বাঁধার আয়না, তাদের স্বামী, তাদের শ্বশুর-শাশুড়ি দেওর-ননদ, তার স্বামীর কুকুর, এ সবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। শরীর ও শারীরিক সম্পর্কের দেওয়াল পেরিয়ে দূরে—অনেক দুরে পালিয়ে এসে তারা কখনাে নিজেদের পুরনাে পরিবেশ, নিজেদের অবিবাহিত দিনের স্বাধীন বােধগলিকে যাচাই করে দেখতে পায় না, বা দেখে না। তারা যেমন করে তাদের পুরনো জীবন, তাদের পুরনাে ভালােবাসা, তাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগাকে হারিয়ে ফেলে তেমন করে কোন পুরুষ কখনাে তা হারায় না। সত্যিকারের কোন পুরুষ কোন মেয়েকে সত্যিকারের ভালোবাসলে তাকে কখনাে ভােলে না, তাকে কখনাে ভুলতে পারে না। আর পারে না বলেই, এত ফিরে ফিরে আসা। কিছু পাওয়ার নেই, কিছু চাইবার নেই, কিছু বলার নেই জেনেও স্ত্রীর কাছ থেকে পালিয়ে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে পালিয়ে নিজের কাছ থেকেও পালিয়ে এসে একজনকে শুধু একবার দেখার জন্য, তার চোখে চোখ রেখে শুধু কিছুক্ষন নিঃসঙ্গে বসে থাকার জন্য এতদূর এই শীতের নিষ্ঠুর রাতে আসা।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।