পারফর্মিং আর্ট বা প্রয়ােগশিল্পের পঙক্তিতে আবৃত্তি মর্যাদার আসন পেয়েছে আবৃত্তিহীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইদানীং বড় একটা চোখেই পড়ে না। উপরন্তু, আবৃত্তি পেশাদারী শিল্পের স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। প্রথম সারির খ্যাতিমান আবৃত্তিকাররা ভদ্রস্থ সম্মানদক্ষিণার বিনিময়ে প্রায়ই সাদর আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। পেশাদার সংগীতশিল্পীর গান বা বাজনাই যেমন একমাত্র জীবিকা, আবৃত্তি এখনাে পর্যন্ত সেরকম হয়ে উঠতে পারেনি বটে, তবে সেদিন খুব বেশি দূরেও নয়। অথচ, আমাদের কালে, আমার শৈশব বা কৈশােরে তাে নয়ই, এমন কী প্রথম যৌবনেও, একালের মতাে আবৃত্তির এত বিপুল সমাদর ছিল না। তখন বৎসরান্তে একবার স্কুলের পারিতােষিক বিতরণী অনুষ্ঠানে কিংবা কলেজের পুনর্মিলন উৎসবে আবৃত্তির জন্য দু'একজনের ডাক পড়তাে। অভিভাবকের সেরকম দাপট থাকলে পাড়ার ক্লাবের রবীন্দ্র-নজরুল-জন্মােৎসবে আবৃত্তির বাড়তি সুযােগ অযাচিতভাবেই জুটে যেতত। সুকান্ত ভট্টাচার্য তখনও কবিখ্যাতি পাননি। তাই ঐসব অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গুটিকয়েক কবিতাই ঘুরে ফিরে নানান জনের কণ্ঠ বদল করতাে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। এইভাবেই নিভৃতচারিতায় আবৃত্তির দিন বয়ে যাচ্ছিল।
তারপর একালে আবৃত্তিকে ঘিরে অকস্মাৎ উদ্দামতার জোয়ার এলাে; আর এই উদ্দামতার কেন্দ্রবিন্দুতে যার অধিষ্ঠান তিনি হলেন কাজী সব্যসাচী। অনস্বীকার্য যে, সাধারণ মানুষের কাছে আবৃত্তিকে হৃদয়গ্রাহী করে তােলার কৃতিত্বের সিংহভাগের দাবিদার কাজী সব্যসাচী এবং আবৃত্তি যে আজ পুরােপুরি পেশাদারী শিল্প হয়ে উঠেছে তারও পথপ্রদর্শক তিনিই। আগে আবৃত্তি ছিল নিতান্ত শৌখিন বা আধা-শৌখিন সংস্কৃতিচর্চা। বস্তুতপক্ষে, ১৯৬২ সালে আকাশবাণীর ঘােষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সব্যসাচী যদি আবৃত্তিকে জীবিকার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে না নিতেন তাহলে পেশাদারী প্রয়ােগশিল্প হিসেবে আবৃত্তির বাড়বাড়ন্তের এই শুভদিন আসতে আরাে কত-যে বিলম্ব হতাে কে জানে! দীর্ঘ ঋজু বলিষ্ঠ চেহারায় প্রবল ব্যক্তিত্ব, মঞ্চাবতরণে জড়তাহীন স্বাচ্ছন্দ্য, সাবলীল পরিবেশনশৈলী, উদাত্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বর, আকাশবাণীর ঘােষক হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তা এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুত্ৰপরিচয়—এই সব কিছু মিলিয়ে সব্যসাচীর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল তাতে তিনি অনায়াসেই শ্রোতৃচিত্ত জয় করতে পেরেছিলেন এবং অচিরেই আবৃত্তিকার হিসেবে একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা ও রাজ্যজোড়া খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। কাজী সব্যসাচীর তড়িৎসাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হুবহু তারই অনুকারী কয়েকজন তরুণ আবৃত্তির আসরে নেমে পড়লেন, তাঁদের ঘিরে ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যাও দেখতে দেখতে স্ফীত হয়ে উঠলাে।
অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: এপ্রিল ১০, ১৯০১ - মৃত্যু: জুন ১২, ১৯৮৬) বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে'র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নাম অবিনাশী বন্ধন ও সমসাময়িকতার বিস্ময়ে জড়িয়ে আছে। শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি এবং সৃজনশীল গদ্যশিল্পী অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সেই সময় জর্জ বার্নাড'শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পাস্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রভৃতি বিখ্যাত মনীষীর সান্নিধ্যে আসেন।