মন্দিরময় ত্রিপুরা, রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভূমি ত্রিপুরা, প্রিয় গায়ক কুমার শচীনদেব বর্মনের জন্মভূমি ত্রিপুরা, আমার কাছে এক পরম পবিত্রতীর্থ। কিছুক্ষণ আগে সেই ত্রিপুরা-তীর্থের মাটি প্রথম স্পর্শ করেছি। প্রথম প্রেমের মতো প্রথম ভ্রমণও মনের মুকুরে অমলিন থেকে যায়। কারণ ভ্রমণ যে জীবনেরই নামান্তর। জীবনে তো কত নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু সেই প্রথম কিশোরীটির লাজনম্র হাসিটুকু আজও ভুলে যাই নি। তেমনি আমি এর পরেও কয়েকবার ত্রিপুরায় এসেছি। কিন্তু একটি সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে এই ত্রিপুরা আগমনের কথা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কারণ এটি আমার প্রথম ত্রিপুরা-দর্শন। রোজনামচা লেখার অভ্যেস আমার নেই। তাই এ ভ্রমণের বিবরণ কোথাও লেখা নেই। আমি আমার মনের ডায়ারি হাতড়ে এ লেখা শুরু করেছি। জানি না এ লেখা শেষ করতে পারব কিনা? কারণ জীবন যে অনিত্য, তা এখন অবিরত অনুভব করি। কোনো কাজ শুরু করলেই শেষ করতে পারব, এমন মনের জোরও আর আমাতে অবশিষ্ট নেই। তাই এই বই শেষ না করতে পারলে কেবল একটাই পরিতাপ থেকে যাবে যে সেদিন ত্রিপুরার মানুষদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি পালন করতে পারলাম না। তাহলেও জীবনদেবতার ওপরে আমার কোনো অভিমান রইবে না। কারণ আমার প্রতি তাঁর যে সীমাহীন কৃপা। না চাইতেই তিনি আমার দু-হাত ভরে তাঁর প্রসাদ তুলে দিয়েছেন। কিন্তু থাকগে এসব কথা। তার চাইতে আমার সেই প্রথম ত্রিপুরা-ভ্রমণের কথাতেই ফিরে আসা যাক। সেবারে ত্রিপুরার সাহিত্যরসিকগণ তেলিয়ামুড়া নামে একটি জায়গায় এক বঙ্গসাহিত্য-সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে আমি প্রথম আগরতলায় এসেছি। আমার সঙ্গে এসেছেন সুসাহিত্যিক সুমথনাথ ঘোষ, জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়, কবি দীনেশ দাশ ও সাংবাদিক দক্ষিণারঞ্জন বসু। অধিবেশনের উদ্যোক্তাগণ অনেকেই বিমানবন্দরে আমাদের সানন্দ স্বাগত জানালেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম মনে আছে তাঁরা হলেন-ডাঃ রথীন্দ্র দত্ত, হরশঙ্কর রায় চৌধুরী, শ্রীমতী লীনা সেনগুপ্ত, বীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আমার অনুজপ্রতিম অধ্যাপক ড. শিশিরকুমার সিন্হা প্রমুখ। ওঁদের সঙ্গে আমরা লাউঞ্জেও এসে বসি। একটু বাদেই একজন পুলিশ অফিসার সামনে এসে আমাকে নমস্কার করেন। আমি প্রতি নমস্কার করে তাঁর দিকে তাকাই।
Shonku Moharaj বর্তমান বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তম নাম। সুগত সাতাশ বছরে তাঁর ছত্রিশটি শিল্পকর্মের মধ্যে তিনখানি বাদে বাকি সবকটিই ভ্রমণকাহিনী। তাঁর পনেরোটি হিমালয়-কাহিনীর শেষখানি ব্রহ্মলোকে। বিগত গ্রন্থে শঙ্কু মহারাজ-এর সারথ্যে পাঠক-পাঠিকার মানস-ভ্রমণ সম্পণ ‘হয়েছে সূদূরবতী’ সুইজারল্যান্ডে, জয়ন্তী জুরিখে। য়ুরোপের আলপস থেকে স্বল্প স্বাদবদল করে লেখক আবার ফিরে এলেন হিমালয়ে, দেশমাতার পূজায় পুনরায় নিজেকে নিবেদন করতে। বিচ্ছেদবাদ যখন ভারতের অঙ্গচ্ছেদনে শামিল, জাতীয় চেতনার সামনে তখুনি তিনি তুলে ধরলেন গুর্জর কিশোরী শ্যামা আর কিশতোয়ারী মালবাহক আবদুল রসিদের কথা, যারা বিদায়বেলায় বাঙালি অভিযাত্রীদের জন্য চোখের জল ফেলে, হিন্দু সাহেবদের নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কারফিউ কবলিত শহরে ছুটে আসে। বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিত কিশতোয়ার-হিমালয়ের ওপরে রচিত বাংলাসাহিত্যের প্রথম ভ্রমণকাহিনী এই ব্রহ্মলোকে। কলকাতার একদল দামাল যুবক গিয়েছিলেন কিশতোয়ার হিমালয়ের দুগেমতম শৃঙ্গ ব্রহ্মা-১ (২১,০৪৯) পর্বতাভিযানে। লেখক সেই অভিযাত্রীদের অন্যতম। তবে তিনি কেবল পর্বতারোহণ নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। সেই সঙ্গে তাঁর সাবলীল ভাষায় বলেছেন, অনাবিষ্কৃত বিশতোয়ার হিমালয়ের ভাষা ভূগোল ইতিহাস গাছপালা পশু-পাখি পাহাড় ও পথের কথা, বলেছেন সরল ও সুন্দর মানুষদের কথা, যাঁদের সহজ জীবন আর লেখকের সরস লিখন একযোগে পাঠক-পাঠিকাকে নিয়ে যাবে ব্রহ্মলোকের ব্রজ্যায়।