মধুময় বৃন্দাবন। বৃন্দাবনের আকাশে মধুচন্দ্র, বাতাসে মধুর ব্যজন, মাটিতে মন-মধুকর। হিরণ্যকশিপুর পুত্র মধুদৈত্যের মৃগয়াভূমি বৃন্দাবন। মধুবনবিহারী মধুসূদনের লীলাভূমি বৃন্দাবন সেই মধু-বৃন্দাবনে চলেছি আমরা। আমরা মানে সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, সেবক, শিষ্য ও অশিষ্য মিলিয়ে জন-ষাটেক যাত্রী। চলেছি তুফান এক্সপ্রেসে। আজকাল যেখানে সতেরো ঘণ্টায় হাওড়া থেকে দিল্লি পৌঁছনো যাচ্ছে, সেখানে তুফানে লাগছে ত্রিশ ঘণ্টা। কাজেই তুফান এক্সপ্রেস আর কোনওমতেই এক্সপ্রেস নয়, তুফান তো নয়ই। তবু বৃন্দাবন-যাত্রীদের তুফানই একমাত্র ভরসা। কারণ হাওড়া থেকে এক গাড়িতে মথুরা যেতে হলে, তুফান ছাড়া আর কোনও ট্রেন নেই। তাই তুফান, তুফান নয় জেনেও আমরা আজ সকাল ন'টার সময় হাওড়া স্টেশনের এই ন’নম্বর প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়েছি। প্ল্যাটফর্মের ওপরে মালপত্রের বিরাট স্তূপ—বিছানা, বাক্স, স্যুটকেশ, কিটব্যাগ আর পোঁটলা-পুঁটলি। সেই স্তূপের চারিপাশে জটলা। অধিকাংশই মহিলা এবং বৃদ্ধা। বয়স পঞ্চাশ থেকে আশির মধ্যে। কেবল চার-পাঁচজন যুবতী আর তাদের মধ্যে মাত্র দুটি মেয়ে অবিবাহিতা। মহিলাদের পরেই গেরুয়াধারীদের সংখ্যা। পাঁচজন সন্ন্যাসী, জন-দশেক ব্রহ্মচারী ও জন-সাতেক সেবক। সন্ন্যাসীদের পরনে বহির্বাস, গায়ে উত্তরীয়, হাতে দণ্ড ও পায়ে খড়ম। ব্রহ্মচারীদের পরনে ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি ও পায়ে কাপড়ের জুতো। সেবকদের পোশাক ব্রহ্মচারীদের মতোই। সেবকরা হচ্ছেন সন্ন্যাসাশ্রমের শেষ সারির সদস্য। তাঁরা হরিনাম নিয়ে আশ্রমিক জীবন শুরু করেন। পরে যোগ্যতা বিচার করে গুরুমহারাজ তাঁদের দীক্ষা দিয়ে ব্রহ্মচারী পদে উন্নীত করেন। অবশেষে দীর্ঘকাল ধরে তাঁদের পাঠ ও প্রচার দক্ষতা যাচাই করে তিনি তাঁদের সন্ন্যাস দান করেন। তাঁরা ত্রিদণ্ডী গোস্বামী পদে অভিষিক্ত হন। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা সকলেই ত্রিদণ্ডী, অর্থাৎ ‘কায়’, ‘মন’, এবং ‘বাক্’কে ভগবৎ-সেবায় ‘দণ্ডিত’ করেছেন। তাঁরা গোস্বামী। যিনি বাক্য, মন, ক্রোধ, জিহ্বা, উদর এবং উপস্থ অর্থাৎ কামের বেগ জয় করেছেন, তিনিই গোস্বামী তথা জগদ্গুরু। অতএব গোস্বামীরা হলেন বিজেতেন্দ্ৰিয় মহাভাগবত। আমরা সংখ্যায় সবচেয়ে কম। সব মিলিয়ে জন-পনেরো। তার মধ্যে আবার জন- দশেক আশ্রমের শিষ্য। অর্থাৎ আমাকে নিয়ে অশিষ্যদের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। শিষ্য না হলে, এমনকী বৈষ্ণব না হলেও এই আশ্রমের বনযাত্রায় অংশ নিতে বাধা নেই কোনও। গুরুমহারাজের অনুমতি নিয়ে খরচ দিয়ে যে-কেউ যাত্রায় অংশ নিতে পারেন। শিষ্য বা বৈষ্ণব হবার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
Shonku Moharaj বর্তমান বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তম নাম। সুগত সাতাশ বছরে তাঁর ছত্রিশটি শিল্পকর্মের মধ্যে তিনখানি বাদে বাকি সবকটিই ভ্রমণকাহিনী। তাঁর পনেরোটি হিমালয়-কাহিনীর শেষখানি ব্রহ্মলোকে। বিগত গ্রন্থে শঙ্কু মহারাজ-এর সারথ্যে পাঠক-পাঠিকার মানস-ভ্রমণ সম্পণ ‘হয়েছে সূদূরবতী’ সুইজারল্যান্ডে, জয়ন্তী জুরিখে। য়ুরোপের আলপস থেকে স্বল্প স্বাদবদল করে লেখক আবার ফিরে এলেন হিমালয়ে, দেশমাতার পূজায় পুনরায় নিজেকে নিবেদন করতে। বিচ্ছেদবাদ যখন ভারতের অঙ্গচ্ছেদনে শামিল, জাতীয় চেতনার সামনে তখুনি তিনি তুলে ধরলেন গুর্জর কিশোরী শ্যামা আর কিশতোয়ারী মালবাহক আবদুল রসিদের কথা, যারা বিদায়বেলায় বাঙালি অভিযাত্রীদের জন্য চোখের জল ফেলে, হিন্দু সাহেবদের নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কারফিউ কবলিত শহরে ছুটে আসে। বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিত কিশতোয়ার-হিমালয়ের ওপরে রচিত বাংলাসাহিত্যের প্রথম ভ্রমণকাহিনী এই ব্রহ্মলোকে। কলকাতার একদল দামাল যুবক গিয়েছিলেন কিশতোয়ার হিমালয়ের দুগেমতম শৃঙ্গ ব্রহ্মা-১ (২১,০৪৯) পর্বতাভিযানে। লেখক সেই অভিযাত্রীদের অন্যতম। তবে তিনি কেবল পর্বতারোহণ নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। সেই সঙ্গে তাঁর সাবলীল ভাষায় বলেছেন, অনাবিষ্কৃত বিশতোয়ার হিমালয়ের ভাষা ভূগোল ইতিহাস গাছপালা পশু-পাখি পাহাড় ও পথের কথা, বলেছেন সরল ও সুন্দর মানুষদের কথা, যাঁদের সহজ জীবন আর লেখকের সরস লিখন একযোগে পাঠক-পাঠিকাকে নিয়ে যাবে ব্রহ্মলোকের ব্রজ্যায়।