অরণ্য এবং বন্য জীবজন্তুর হিসেবে ভারত বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর অন্যতম। তার সোজাসুজি কারণ হলো ভারতে যেমন একদিকে রয়েছে নির্জন পাহাড় পর্বত, বরফে ঢাকা বন্ধুর প্রান্তর, বিশাল বৈচিত্র্যে ভরা ঘন জঙ্গল, সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের পাদদেশ—তেমনি অপরদিকে আছে শুকনো কাঁটাঝোপ-ঝাড়ে ভরা সুবিশাল প্রান্তর, মরুভূমি এবং জলাভূমিতে গরান গাছের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। অর্থাৎ বন্য জন্তুজানোয়ারদের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই রয়েছে ভারতের বনে জঙ্গলে। অরণ্যে এবং প্রান্তরে। প্রায় দু' কোটি বছর আগে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিশাল ভূখণ্ডে চিড় ধরে। সেই ভূখণ্ডের যে অংশটা আজকের ভারত— সেই অংশ উত্তরদিকে সরতে থাকে। প্রায় সত্তর লক্ষ বছরের কাছাকাছি ইউরেশিয়া ভূখণ্ডকে ঠেলে দিয়ে সেই ভূখণ্ড নিজের জায়গা খুঁজে নেয়। সেই ভূখণ্ডের চাপে সৃষ্টি হয় হিমালয়ের। এই সুদীর্ঘ সময়ে পৃথিবীও পেরিয়ে এসেছে অনেকগুলো স্তর। ইওসেনে, অলিগোসেনে, মিওসেনে, প্লিওসেনে এবং প্লিয়াস্টোসেনে ইত্যাদি সভ্যতার পর্বগুলো। প্রাক্ সভ্যতার সময়ের টেথিস সমুদ্র পরবর্তী যুগের হিমালয় পর্বত কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠের চাপে এখনো তার আকাশছোঁয়া উচ্চতা বাড়িয়েই চলেছে। আর টেথিস সমুদ্র তো অস্তিত্ব-ই হারিয়ে ফেলেছে। তবে একদা যে সমস্ত হিমালয় অঞ্চলটাই টেথিস সমুদ্রের আওতায় ছিল তাতে সন্দেহ নেই। কারণ হিমালয় পর্বতের অনেক উঁচুতেও সামুদ্রিক প্রাণীদের ফসিল পাওয়া গেছে। এই ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। অভ্রভেদী বরফে ঢাকা পর্বতচূড়া, শুকনো কিন্তু তীব্র ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়া সমতলভূমি, বৈচিত্র্যময় বনভূমি। হিমালয়ের পাদদেশের তরাই জলাভূমি, সবুজ আদিগন্ত বিস্তৃত ঘাসভূমি এবং সুগভীর বনাঞ্চল। তার সঙ্গে রয়েছে নোনামাটির গরান গাছের বনভূমি, বিশাল দীর্ঘকায় গাছ-গাছালির ঘন অরণ্য, কর্দমাক্ত জলাভূমি। গ্রীষ্মে প্রখর সূর্যের তাপ, শীতে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা আর বর্ষায় আকাশভাঙা বৃষ্টি—বৈচিত্র্যপূর্ণ জন্তুজানোয়ারের আবাসস্থল হিসেবে ভারত তাই পৃথিবীতে অন্যতম দেশ হিসেবে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছে। ওরিয়েন্টাল বায়োগ্রাফিক অঞ্চলের মধ্যেই পড়ে ভারত। সেই প্রাচ্য বায়োগ্রাফিক অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত ভারতের পুবে জাভা, বালি প্রভৃতি দ্বীপপুঞ্জ। উত্তরের সীমান্ত টানা যেতে পারে হি লয় ডিঙিয়ে দক্ষিণ চীনকে নিয়ে। পশ্চিম সীমান্ত ইন্দাস উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চল ধরে নিলে সম্ভবত ভুল বলা হবে না। এই মহাঅঞ্চলের মধ্যে যে তিনটে পৃথক অঞ্চল পড়ে— তাদের মধ্যে অনেক কিছুর বৈসাদৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু গাছপালার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যায়। ইন্দোচাইনিজ, ইন্দো- মালায়ান আর ভারত। ভারতের বনাঞ্চলের সঙ্গে আফ্রিকার গাছ-গাছালিরও কিছু মিল পাওয়া যায় । হয়তো বা উভয় দেশ-ই গ্রীষ্মপ্রধান বলে। যাইহোক, প্রাকৃতিক নিয়মেই এই বিশাল ভূখণ্ডে একদা প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। ধীরে ধীরে মানুষের বসতিও গড়ে ওঠে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রচলিত জীবনধারাতেও প্রচুর পরিবর্তন নেমে আসে। বৃহৎ নদ-নদীগুলো প্রতি বছর বন্যায় ধোয়ার জন্য তীরভূমি ফসলের ভারে উপচে পড়ে। মানুষ তাই বসতির তাগিদে এইসব মহা নদনদী গঙ্গা, নর্মদা, ব্রহ্মপুত্রের আশেপাশে বসতি গড়ে। তখন কিন্তু মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে-মিশিয়ে নিয়ে থাকতো। জনবিস্ফোরণ না ঘটায় মানুষ তার সামান্য দৈনন্দিন প্রয়োজন প্রকৃতির থেকেই জোগাড় করে নিতো। তবে তা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়। আসলে তৎকালীন মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একই বন্ধনে বাঁধা ছিল। মহেঞ্জোদারো, হরোপ্পা ইত্যাদি সময়ের যে ছবি মানুষ পেয়েছে তা'তে অনেক জন্তুজানোয়ারের ছবি ও রয়েছে—যা আজ বহু যুগ আগেই মানুষ বিলুপ্ত করে দিয়েছে। বেদের সময়ের বাণপ্রস্থ অর্থাৎ জীবনের শেষ ভাগ বনভূমিতে কাটানোর নির্দেশ ছিল। যাতে মানুষ তার নিজের তাগিদেই বনভূমি এবং অরণ্য রক্ষা করে চলে। অতীতকালে পাঁচটা বেড়াল জাতীয় প্রাণী যে সারা ভারত এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াতো তা’তে সন্দেহ নেই। স্নো-লেপার্ড, বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ এবং লেপার্ড। স্নো-লেপার্ডকে দেখা যেতো হিমালয়ের বরফে ছাওয়া পাহাড়ী অঞ্চলে ; লেপার্ড ভারত ছাড়াও শ্রীলংকাতেও পাওয়া যেতো। যেখানে চিতা বা বাঘের কোনদিন পদার্পণ ঘটে ওঠেনি। সম্ভবত শ্রীলংকা ভূ-তাত্ত্বিক কারণে ভারত মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরে বাঘ বা চিতার ওদেশে পাড়ি দেওয়ার আর সুযোগ হয়নি। ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলেই ওরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। বাঘের অধিকারে শুধু সারা ভারত-ই নয়, উত্তর পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তরে সাইবেরিয়া, পূর্বে চীন এবং দক্ষিণ-পূর্বে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বাঘের বিচরণক্ষেত্র ছিল। এই উপমহাদেশের বিরাট জায়গা নিয়ে সিংহের দল মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতো। পশ্চিম প্রান্তে এশিয়া মাইনর, উত্তরদিকে ভারতের বিহার প্রদেশের সমতলভূমি এবং পাহাড়িয়া অঞ্চল। তবে নর্মদার উত্তরদিকেই কিন্তু সিংহ তার আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের অঞ্চল গড়ে নিয়েছিল। চিতাও সিংহ অধিকৃত অঞ্চলেই ঘুরে বেড়াতো। তবে অনেকটা দক্ষিণ পর্যন্ত চিতাদের দেখা যেতো—যেসব অঞ্চল সিংহের দল সাধারণত এড়িয়ে চলতো। রাজকীয় হাতির ফ্ল একদা ইন্দো-চায়না এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অরণ্য থেকে উত্তরে বার্মা, নেপাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতো। তরাই অঞ্চল ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশের পাহাড়গুলোর পাদদেশে এবং শিবালিকের কিছুটা অঞ্চলের বনে জঙ্গলেও ওদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো। তারপর গাঙ্গেয় সমতলভূমি পেরিয়ে দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা, সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত ওদের অবাধ গতিবিধি ছিল। এক শিভ্ গণ্ডারদের বিচরণক্ষেত্রও হাতির দলের অনুরূপ-ই ছিল। তবে দক্ষিণ ভারত ছাড়া। অবশ্য পশ্চিমদিকে পেশোয়ার এবং ইন্দাস উপত্যকাতেও ওদের নিয়মিত ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো। আর আজ? আজ পূর্ব রাজস্থান, বিশেষ করে ভরতপুর থেকে সোহাই মাধোপুর রেল ভ্রমণের সময় ট্রেনের জানালায় দৃষ্টি রাখলেই বোঝা যাবে যে সেইসব দিনের বন্য-পশুদের বিচরণক্ষেত্র কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অরণ্য উধাও হয়ে গিয়ে অঞ্চলগুলো উত্তর ভারতের প্রচণ্ড দাবদাহে জ্বলে পুড়ে খাক্ হয়ে গেছে। পাহাড়গুলোর গাছ গাছালি কেটে নিয়ে গেছে। খাদান খুঁড়ে খুঁড়ে উলঙ্গ পাহাড়গুলোর গায়ে দগদগে ক্ষতের চিহ্ন। সর্বত্র। এমন কি ছাগল আর ভেড়ার দৌরাত্মে কাঁটাগাছের ঝোপঝাড়ও আর অবশিষ্ট নেই। পৃথিবীর প্রায় সবদেশ-ই আজ অভয়অরণ্য গড়ে তোলার কাজে মননিবেশ করেছে। অবশ্য তাছাড়া অন্য কোন উপায়ও আর আমাদের জন্য অবশিষ্ট নেই, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এইসব জন্তুজানোয়ারদের তুলে ধরা যেতে পারে। আর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ব্যবস্থা তো ইতিমধ্যেই টাল খেয়েছে। তাই এই বিষয়ে এই গ্রন্থের মানুষদের আরো বেশি চিন্তা-ভাবনা এবং সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়। হ্যাঁ, নিজেদের স্বার্থে। বাঁচার তাগিদে।