"গদ্যসমগ্র" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, লিঙ্গ-রাজনীতির মিশ্র আলােয় অসামান্য হয়ে আছে কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের গদ্যের ভুবন। তিনটি উপন্যাস এবং তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ—এটুকুই তার গদ্য-উদ্যাপন। কবিতায় যেমন, তার গদ্যেও তেমনই উজ্জ্বল হয়ে থাকে স্বতন্ত্র এক দৃষ্টি। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর বিপন্ন অস্তিত্ব নিয়ে মল্লিকা বরাবরই যন্ত্রণাকাতর, তর্কমুখর। ‘সীতায়ন’ উপন্যাসে আর্য-রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তার কল্পনার সীতা শ্লীলতাহানির পরে’ উপন্যাসে চিত্রিত হয় ধারাবাহিক নারী-লাঞ্ছনা ও আত্মপ্রতারণায় ভরা এই সমাজ। কবির বউঠান’ উপন্যাসটি জীবনের অন্তিম পর্বে রচিত। অসুস্থ মল্লিকার কলমে ঠাকুরবাড়ির বিনির্মাণটি যেন তার শেষ শ্রদ্ধা রবীন্দ্রনাথকে। হয়তাে-বা অন্তরালে জেগে রইল সংবেদনশীল এক নারীর সংক্ষুব্ধ হৃদয়। মল্লিকার প্রবন্ধগুলিতে কোনও আড়াল নেই। ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’ প্রবন্ধগ্রন্থে সরাসরি তুলে ধরেছেন পুরুষ-পৃথিবী নিয়ে তার প্রশ্ন এবং নারী-স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তা ও যুক্তিগুলি। ‘পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্র’ গ্রন্থে স্পষ্ট করেছেন ব্যক্তি নয়, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। ‘বিবাহ বিচ্ছিন্নার আখ্যান’ সমাজ ও সাহিত্যনির্ভর এক মননশীল গবেষণা। মল্লিকার ‘গদ্যসমগ্র প্রকৃতপক্ষে একটিই বই, একটি দীর্ঘ চেতনাপ্রবাহ বলা যায়, একটি অবশ্যপাঠ্য মানবীবিদ্যার ভাষ্য, নিজের জীবন ব্যয় করে যা লিখে গিয়েছেন মল্লিকা।
মল্লিকা সেনগুপ্তর জন্ম ২৭ মার্চের ১৯৬০ সালে ভারতের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। তাঁর কবি জীবন শুরু ১৯৮১ সালে এবং সেই থেকে তিনি ১১টি কবিতার বই, দুটি উপন্যাস এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ৯০ এর দশকে তিনি অপর্ণা সেন সম্পাদিত 'সানন্দা' পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করতেন। স্বামী সুবোধ সরকারের সাথে তিনি 'ভাষানগর' নামক একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। মল্লিকার কবিতা আপষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখনির গুণে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর লেখা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে সুকান্ত পুরস্কার, বাংলা একাদেমি এ্যাওয়ার্ড এবং ফেলোশিপ ফর লিটারেচার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ইতিহাসের ব্রাত্য নারী চরিত্ররা প্রায়ই তাঁর লেখায় পুনর্জীবিত হয়েছেন। সমসাময়িক কবি সংযুক্তা দাসগুপ্তের ভাষায় "তার কবিতায় নারীস্বত্বা কেবলমাত্র অন্তর্ভূতি সচেতনতা হিসেবেই থেকে যায় না, সেটা প্রস্ফুটিত হয় সমস্ত প্রান্তিক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ।"