হলদিপোঁতা ধাওড়া একটি অখ্যাত জনপদের নাম যার বুক ছুঁয়ে চলে গিয়েছে জগৎখালি বাঁধ আর বুড়ি গাং। নির্দিষ্ট কোনও পেশা নেই ধাওড়া পাড়ার মানুষদের। এই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ নর-নারীই শ্রমজীবী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারা শোষণ আর বৈষম্যের বাঘনখে আক্রান্ত। তাদের জীবনে অভাব মাঠ-কেঁচোর মতো সহজলভ্য, শিক্ষা সেখানে তেলহীন লম্ফর পোড়া সলতে। এক অসম লড়াইয়ের উত্তাপ এই সুদীর্ঘ উপন্যাসের গতিকে করেছে বেগবান মানুষ প্রকৃতি নদী ও নারী জীবনের চলমান ছবি হয়ে ঘুরে ফিরে এসেছে নানা অভিঘাতে। দু' মুঠো ভাত কিংবা রুটির জন্য মানুষ স্বভূমি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে। ‘অনন্ত দ্রাঘিমা'য় অভাব দুষ্টক্ষত এবং অভিশাপ। আর সেই অভাব এবং বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের বাতাস কেঁপে উঠছে নানা সময়মুখী আন্দোলনে। শহর অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে সেই আগুন উসকে দিতে। গ্রামের ধুলোওড়া বাতাসের ভেতর থেকে তারা অপসারিত করতে চেয়েছে অসাম্যের দানবকে। রঘুনাথ এই পোড় খাওয়া সমাজের একজন। গুয়ারাম, লুলারাম, চুনারাম কিংবা ভিকনাথ তার ব্যতিক্রম নয়। মানবিক মূল্যবোধ আর বিশ্বাসের পলিমাটি দিয়ে গড়া এই ধ্রুপদী উপন্যাস সাহিত্যিক অনিল ঘড়াইয়ের নিরপেক্ষ কলমে হয়ে উঠেছে চিরকালীন আখ্যান।
অনিল ঘড়াইয়ের জন্ম ১৩৬৪ সালের ১৫ কার্তিক, (ইং ১ নভেম্বর, ১৯৫৭), পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার এগরা থানার অন্তর্গত রুক্মিণীপুর গ্রামে। পিতা—অভিমন্যু ঘড়াই, মাতা—শ্রীমতী তিলোত্তমা ঘড়াই। শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে নদীয়া জেলার কালীগঞ্জে। কর্মসূত্রে ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের আধিকারিক। ‘কাক’তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘নুনবাড়ি’, প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০টিরও অধিক। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি কাব্যসাধনায় তিনি ছিলেন মগ্ন। শিশু কিশোর সাহিত্যেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। পেয়েছেন সোপান সাহিত্য পুরস্কার, সর্বভারতীয় সংস্কৃতি পুরস্কার, পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় আকাদেমি পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, তারাশঙ্কর পুরস্কার, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে সাহিত্য পুরস্কার, সিংভূম সাহিত্য সম্মান, একুশে স্মারক সম্মান, পদ্মা-গঙ্গা পুরস্কার, ভারত এক্সেলেন্সি অ্যাওয়ার্ড অ্যান্ড গোল্ড মেডেল, সাহিত্য সেতু পুরস্কার এবং সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার এবং সম্মান। হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রখর বাস্তববাদী, মানবদরদী এই তরুণ ভালোবাসতেন শব্দের তুলিতে মানুষকে চিত্রায়িত করতে। মানুষের কাছে যাওয়া তাঁর প্রিয় সখ। লেখকের অকালপ্রয়াণ ২২ নভেম্বর ২০১৪ ৷