খুব ছোটবেলায় বিবেকানন্দকে নেহাতই ঠাকুর-দেবতার মত ভক্তি করতাম ; কৈশোরে ‘বর্তমান ভারত’ পড়ে জাগল বিস্ময় ৷ কিন্তু তখন আর বিবেকানন্দকে নিয়ে বিশেষ পড়াশুনা করতে পারিনি। তখন বিবেকানন্দকে নিয়ে এত লেখালিখিও হয়নি, যা ছিল তাও বিশেষ সহজলভ্য ছিল না। তারপর বাধল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কলকাতায় জাপানি বোমা, কলকাতা ত্যাগ ও প্রত্যাবর্তন, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলন, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতার পথেঘাটে স্টেশনে সর্বহারা উদ্বাস্তুর ভিড়। দেশে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই। চারদিকে হাহাকার। এরই মধ্যে সকাল- বিকেল ছাত্র পড়াই ও কলেজে পড়ি। এরই সঙ্গে শুরু করলাম খবরের কাগজের রিপোর্টারি। মেতে থাকি বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। না, বিবেকানন্দকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা পড়াশুনা করা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিকতার জন্য দিল্লী পাড়ি দেবার পরই বিচিত্র ও পরস্পর- বিরোধী কিছু মানুষের উপর বিবেকানন্দের বিস্ময়কর প্রভাব দেখে চমকে উঠলাম। তারপর টুকটাক পড়াশুনা শুরু করি বিবেকানন্দকে নিয়ে কিন্তু অসম্ভব ব্যস্ততা ও নিয়মিত দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবার জন্য খুব বেশি এগুতে পারি না। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন গল্প- উপন্যাস লেখালেখিতে মেতে উঠলাম। তবু সময়-সুযোগ পেলেই পার্লামেন্ট লাইব্রেরিতে বসে পড়ি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে নিয়ে লেখা বই । যত পড়ছি, তত আগ্রহ বাড়ছে। গত পাঁচ-সাত বছর ধরেই বিবেকানন্দকে নিয়ে পড়ছি আর আস্তে আস্তে দানা বাঁধছে কিছু চিন্তা-ভাবনা। গত বছর প্রায় উপন্যাস লিখলামই না, শুধু পড়লাম বিবেকানন্দ এবং তাঁর বিষয়ে নানা বইপত্তর। শুধু মনের তাগিদে লিখলাম ‘বিপ্লবী বিবেকানন্দ'। আমি পণ্ডিতও না, গবেষকও না ; এক নগণ্য বিবেকানন্দ-মুগ্ধ মাত্র। জ্ঞানত সততা ও নিষ্ঠার ত্রুটি করি নি। ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের বইটি ভাল লাগলে ধন্য হবো।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।