আমার নাম সব্যসাচী। সব্যসাচী চৌধুরী। তবে সেই ছেলেবেলায় শান্তিনিকেতন পাঠভবনে ভর্তি হবার দু'এক মাস পরই একদিন আমাদের ক্লাস নেবার সময় কি কারণে যেন স্বপনদা হঠাৎ হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, তুই কবে দু'হাতে বাণ ছুঁড়ে সব্যসাচী হবি, তা তো জানি না ; তাই আমি তোকে অর্জুন বলেই ডাকব। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, অর্জুন! অর্জুন! তখন কি আমি জানি, দু'হাতে বাণ ছুঁড়তে পারতেন বলেই অর্জুনের নাম হয়েছিল সব্যসাচী! তারপর ধীরে ধীরে একদিন শান্তিনিকেতনের সর্বত্র সবার কাছে আমি অর্জুন হয়ে গেলাম। সব্যসাচী চৌধুরী বন্দী রইল শুধু পাঠভবন-সঙ্গীত ভবনের খাতাপত্তরে। এমন কি বাবা-মা পর্যন্ত ওখানে গিয়ে ছেলেমেয়েদের বলতেন, অর্জুনকে একটু ডেকে দাও তো। সঙ্গে সঙ্গে সংহিতা বা সঙ্গীতা দৌড়ে এসে আমাকে বলতো, এই অর্জুন, তোর মা এসেছেন। দৌড়ে বাইরে যা! আরো কত মজার ঘটনা ঘটেছে। পাঠভবনে আমার সঙ্গেই পাঁচ বছর পড়ার পর মন্দিরাও সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হল । আমাদের ক্লাশের বাকি সব ছেলেমেয়েই এসেছিল বাইরে থেকে। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই অন্য ছাত্রছাত্রীদের চাইতে মন্দিরার সঙ্গেই আমি বেশি গল্পগুজব ঘোরাঘুরি করতাম। বিকেলে দু'জনেই একসঙ্গে ঘোষদার দোকানে যেতাম। আড্ডা দিতাম। আবার কোন কোনদিন মাঝ পথেই স্বপনদা আমাদের পাকড়াও করে ধরে নিয়ে যেতেন জয়দেবদার দোকানে। তারপর দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসেই পার্স থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে জয়দেবদার হাতে দিয়ে বলতেন, হ্যাঁরে, কিছু খাবার-দাবার আনতে দে। এই দুটো শিশুকে কিছু খেতে না দিলে ওরা কী আর কোনদিন আমার সঙ্গে তোর দোকানে আসবে ?
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।