চিঠিখানা পড়েই চমকে উঠলাম । খোকন জেলে ! কয়েদী ! না, না, তা হতে পারে না। অসম্ভব। অকল্পনীয়। ছেলেবেলার বন্ধ কৈশোরের খেলার সঙ্গী, কলেজ জীবনের গর্ব' খোকন জেলে বন্দী ? না, না, এ আমার স্বপ্নাতীত। এ আমি ভাবতে পারি না, পারব না। খোকন চোর? খোকন ডাকাত ? খোকন লম্পট-বদমাইস-জুয়াচোর? পাগল না হলে এসব কল্পনাও করা ছেলে কোনো অন্যায় করতে পারে না। তাছাড়া অমন ছাত্র ক'জন হয় ? আমরা থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে বঙ্গবাসী কলেজের গোয়ালে নাম লেখালাম আর আমাদেরই সঙ্গে দিবারাত্র আড্ডা দিয়ে খোকন ম্যাট্রিকে থার্ড স্ট্যান্ড করে প্রেসিডেন্সীতে ভর্তি হল । সেই খোকন এখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ? কিন্তু....... না, না, এর মধ্যে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না ।তবে... এ চিঠি কে লিখল ? অন্য কেউ ? খোকনের নাম করে কে এই চিঠি লিখতে পারে ? চিঠিখানা হাতে নিয়ে কত কি ভাবি। আকাশ-পাতাল। আবোল-তাবোল ৷ তারপর হঠাৎ চিঠিখানার ওপর, খামের ওপর নজর পড়ে। চমকে উঠি । সত্যিই তো এ চিঠি আলিপর সেন্ট্রাল জেল থেকে এসেছে ।... ... চিঠিখানা হাতে নিয়েই চমকে উঠবি, তা আমি জানি। জানি, তুই বিশ্বাস করতে পারবি না, তোদের খোকন, প্রফেসর সেনগুপ্তের প্রিয় ছাত্র বিমলেন্দ, সরকার এখন জেলখানায় বন্দী। আমিও কী কোনোদিন ভেবেছি, আমাকে থানা-পালিস কোর্ট-কাছারির চত্বরে কয়েক বছর ঘোরাঘুরির পর বছরের পর বছর জেলখানায় কাটাতে হবে ?... ঐ দ’এক লাইন পড়েই আমার মাথা ঘরে ওঠে, চোখে অন্ধকার দেখি । কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করি, না পড়ে পারি না । ... আলিপর সেন্ট্রাল জেল নাকি ভদ্দরলোকদের জেল, শিক্ষিতদের জেল ৷ জেলের বাসিন্দা আর তার অভিভাবকদের ভাষায় এর নাম ‘বাব, জেল' । তাই এখানে একটা লাইব্রেরী আছে।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।