মেমসাহেব, এডেন থেকে পোস্ট করা তোমার চিঠি পেলাম । জানলাম, বোম্বে থেকে জাহাজ ছাড়ার পর সারারাত্তির ঘুমুতে পারনি। তুমি না লিখলেও আমি জানি তুমি চোখের জলে বন্যা বইয়েছ, জানি তুমি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছ।একই চন্দ্রাতপের তলায় তুমি আর আমি আছি তবু এই দীর্ঘ ব্যবধান সাময়িক বিচ্ছেদে দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু অত উতলা হবে না । একবার ভেবে দেখেছ কি আমার অবস্থা ? ভেবেছ কি, যে মেমসাহেব আমার অশান্ত জীবনে হিমালয়ের প্রশান্তি এনেছিল, যার ঐ ঘন কালো টানা চোখ আমার সারা মন ভরিয়ে তুলেছিল, যার ভালবাসায় আমার মরা অন্তরে বান ডেকেছিল, যার প্রেমের স্পর্শে আমার যুগযুগব্যাপী নিদ্রা ভেঙেছিল, যে আমার চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল, সেই মেমসাহেবকে পাশে না পেয়ে আমার কি অবস্থা ? হয়ত ভেবেছ, হয়ত ভাবনি। তবে এই বিরহবেদনার মধ্যেও আনন্দ আছে, আছে আত্মতৃপ্তি ৷ আমি নিঃসঙ্গ হলেও নিঃসহায় নই ; একটা অন্তরদ্বীপের মঙ্গলশিখ। আমার কল্যাণ- যজ্ঞের জন্য অহরহ জ্বলছে ভেবে নিশ্চয়ই আত্মতৃপ্তি আছে, আছে নির্ভরতার আনন্দ । তোমাকে জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে এসে আমার মানসিক অবস্থা যে কি হয়েছিল তা তোমাকে লিখে জানানো আমার ক্ষমতার বাইরে। বিকট আওয়াজ করে জাহাজটা ছেড়ে দিতেই আমার বুকের আধখানা গেল ভেঙে । তুমি ডেকের ধারে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ছিলে, কিন্তু আমি ঠিক দেখতে পাইনি । চোখের জলে ঝাপসা হয়ে উঠেছিল তোমার মূর্তি । তোমাকে ভালবেসেছি, তুমি আমায় ভালবাসায় ভরিয়ে তুলেছ। কিন্তু আগে জানতে পারিনি, বুঝতে পারিনি তুমি আমার হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছ ৷
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।