ছোটবেলায় বাঙালীর শৌর্য-বীর্য-ঐতিহ্যের কাহিনী পড়েছিলাম । পড়েছিলাম আমরা বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, যুদ্ধ করেছি 'দশানন জয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে, জেনেছি আমাদেরই ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করেছিলেন, চাঁদপ্রতাপের হুকুমে দিল্লীশ্বরের গদী কেঁপেছিল । আরো, আরো অনেককিছু জেনেছিলাম। শুনেছিলাম অতীশ দীপঙ্করের কাহিনী, পড়েছিলাম ‘কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি বাঙালীর ছেলে ফিরে এলো দেশে যশের মুকুট পরি'। ইতিহাসে মাত্র তিরিশটি নম্বর পেয়ে প্রমোশন পাবার তাগিদে আরো বহু অসংখ্য অতীতগৌরবের কাহিনী জেনেছিলাম। না জানি ভাল ছাত্র হলে আরো কত কি জানতাম ৷ বই-এর পাতায় ছাপার অক্ষরে বাঙালীর অতীতগৌরবকাহিনী পড়ে গর্বে বুকখানা ফেটে পড়ত। বিদ্যায় শিক্ষায়, শিল্পে-সাহিত্যে, সঙ্গীতে-দর্শনে, ধর্মে-আত্মত্যাগে, দেশসেবায়, উদারতায়, নিপীড়িত মানবাত্মার কল্যাণে বাঙালীর নাকি কোন তুলনা হয় না বলে জেনেছিলাম ছাত্রজীবনে । পরে সাংবাদিক-জীবনের প্রথম অধ্যায়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, দেশপ্রিয়- দেশবন্ধু-শ্রদ্ধানন্দ-হাজরা পার্কে, অক্টারলনীর পায়ের তলায়, স্বনামধন্য নেতাদের বক্তৃতা শুনে মনে হতো অতীতের বাঙলা মরেনি, তার হৃদয়-ঐশ্বর্য লুপ্ত হয়নি। যে বাঙলায় কবি জয়দেবের আবির্ভাব হয়েছে, চৈতন্য-রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ-রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি জন্মেছেন, সে বাঙলা কি মরতে পারে ? না, কখনই না। যে বাঙালীর বিপ্লবী আত্মা ইংরেজকে চমকিত করেছিল, বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল, সে বাঙালী কি আবার জাগবে না ? একশ' বার জাগবে । যে সোনার বাঙলার গ্রামে-গ্রামান্তরে চাষী - মাঝি-ফকিরের কণ্ঠে বাউল আর ভাটিয়ালী গানের মধ্য দিয়ে শাশ্বত জীবন- দর্শনের বাণী প্রচারিত হয়েছে চিরকাল, সে দেশের মানুষের মনীষা কি নিঃশেষিত ? না, না, না।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।