কাঁচের চুড়ি তো আর চিরকাল থাকে না। ভেঙে যায়,টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায় ৷ তবু সবাই পরে। গোছা গোছা কাঁচের চুড়ি পরে । হাত ভর্তি করে পরে। শাড়ীর সঙ্গে রং মিলিয়ে পরে। রং-বেরং-এর মনের সঙ্গে রকমারি কাঁচের চুড়ি পরে।সবাই জানে ওগুলো টিকবে না, থাকবে না, থাকতে পারে না ৷ জানলেই কি সব মেনে নেওয়া যায় ? বর্ষার নদীনালাগুলো যখন মাতলামী করে, তখন কি তারা ভাবতে পারে শীতের সকাল, চৈত্রের গোধুলির বিবর্ণ দিনগুলির কথা ? পারে না, ভুলে যায় । বছরের পর বছর ভুলে যায়। হিমালয়-গুঙ্গে বাস করে শ্বেত শুভ্র তুষার উপহাস করে নীচের পৃথিবীকে। অতল জলের আহ্বানে একদিন তাকে ছুটতে হয় স্বর্গ থেকে মর্তে। সে জানে, জেনেও ভুলে থাকার করে। কেতাবে পুঁথিতে সব কিছু লেখা আছে । পড়লেই সব জানা যায় ৷ অনেকেই জানে ৷ জানে ললিতাও । আকাশের কোলে রামধনু ওঠে। তার জীবন দীর্ঘস্থায়ী নয় কিন্তু তবু যখন মেঘমুক্ত আকাশের কোলে রং-এর মেলা বসে তখন সবাই দেখে। দু-চোখ ভরে দেখে ৷ না দেখে পারে না । ললিতাও পারেনি। অনেক দিন কাঁচের চুড়ি পরেনি ললিতা। পরত। তারপর হঠাৎ একদিন কি যেন হলো! ওর প্রায় সব বন্ধুই ললিতা কাঁচের চুড়ি- পরল। কিন্তু কতদিন তার মেয়াদ ? একদিন ভেঙে গেল । হঠাৎ অপ্রত্যাশিত । তবু মন খারাপ হলো। স্বপ্ন ভেঙে যাবার বেদনা, শূন্যতার জ্বালা করল ।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।
Hello, Sign in 
Cart 
