অনেক দিন আগেকার কথা। কিন্তু সব মনে পড়ছে। সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে আমার। মনে থাকবে না? ওই দিনটার কথা কি ভোলা যায়? অসম্ভব। কোনোদিন ভুলতে পারব না। কোনোদিন না, জীবনেও না। এই অ্যালবামটায় আর কটা ছবি আছে? সব ছবি কি ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরায় তোলা সম্ভব? কোনো ক্যামেরাম্যান তুলতে পারে না, পারবে না। যত রকমের যত দামি ক্যামেরাই আবিষ্কার হোক, মানুষের মনের ক্যামেরার কাছে হেরে যাবেই। এই তো এই এত মোটা অ্যালবামে সেই একটি দিনের কত ছবি রয়েছে। কয়েক ডজন ফটোগ্রাফার এইসব ছবি তুলেছিলেন। প্রত্যেকটা ছবি সুন্দর উঠেছে। এত বছর পরেও একটা ছবি নষ্ট হয়নি। মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগেই তোলা হয়েছে। লরিটায় এত ভিড়। কতজন যে সেদিন ওই লরিতে উঠেছিল তার হিসাব নেই। সবার মুখগুলোই ছোট ছোট উঠেছে। কিন্তু তবুও আমি প্রত্যেককে চিনতে পারছি। আনন্দ, বিমল, হেমেন, তুলসী, কানাই... । ওই তো ছোট ভাই! আনন্দে গোরার কাঁধে উঠেছে। গলায় মালা পরেছে। সৌমেনেরই একটা মালা নিয়ে পরেছিল আর কি! সব্বাইকে দেখতে পারছি, চিনতে পারছি। ছবিগুলো সত্যি খুব ভালো উঠেছিল কিন্তু— কিন্তু অত বড় বড় নামকরা প্রেস ফটোগ্রাফাররাও কি আমার মনের ছবি তুলতে পেরেছেন? পেরেছেন কি অশোক, মানু, টিঙ্কুর আনন্দের ছবি তুলতে? দাদার গর্ব? দিদির তৃপ্তি? মা-র বুকভরা স্নেহের ছবি? প্রসেশানটা আমাদের বাড়ির সামনে থামিয়ে সৌমেন মা-দাদাকে প্রণাম করতে এসে এক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়েছিল। শুধু এক মুহূর্তের জন্য। কোনো কথা বলেনি। বলতে পারেনি। অত ভিড়ের মধ্যে আমাকে কি বলবে? কোনো, কথা না বললেও ওই ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে দেখার মধ্যেই সব কথা বলা হয়েছিল। সব কথাই কি মুখ দিয়ে বলতে হয়? নাকি কান দিয়ে শুনতে হয়? ওই এক টুকরো মুহূর্তের ওই অবিস্মরণীয় দৃষ্টিপাতের কি ছবি তোলা যায়? শুধু মনের ক্যামেরাতেই ও-ছবি তোলা যায়। এই পুরনো অ্যালবামটা আমি দেখি না। দেখতে চাই না।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।