এই অর্জুন! অর্জুন! তিরিশ বছর পর ভাগলপুর স্টেশন প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই অর্জুন বলে কে আমাকে ডাকল? এ নামে তো কেউ আমাকে ডাকে না। ছোটবেলায় দু'চারজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর আমার ঠাকুমা ছাড়া কেউ আমাকে এ নামে ডেকেছে বলে মনে পড়ে না। ওরা ছাড়া আর কেউ আমার এ নাম জানে না। ঠাকুমার ভবলীলা বহুকাল সাঙ্গ হয়েছে। আর পুরনো বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায় সবাই তো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে বলে জানতাম ৷ ভাগলপুরে বোধহয় কেউই নেই। তবে কে আমাকে অর্জুন বলে ডাকল? আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থমকে দাঁড়ালাম। আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের প্রায় অর্ধেক প্যাসেঞ্জার ভাগলপুরে নেমেছেন। এই ট্রেনে অনেকেই জামালপুর, কিউল, মোকামা, দানাপার পাটনা যান। এলাহাবাদ বা বেনারস যেতে হলে এটাই একমাত্র ট্রেন। যাত্রীদের অভ্যর্থনা করতে বা বিদায় জানাতেও অনেকে এসেছেন। এই সাত সকালেই ভাগলপুর স্টেশন লোকে লোকারণ্য। না হবার কোনো কারণ নেই। আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের চাইতে বনেদী ও সম্মানিত কোনো ট্রেন এখানে আসে না। তাইতো অকারণেও বহু মানুষ এ সময় ভাগলপুর স্টেশনে পদার্পণ করেন। এক কালে আমরাও এসেছি। নিয়মিত। কারণেও এসেছি, অকারণেও এসেছি। আজ বহুকাল পরে আবার ভাগলপুর স্টেশনে বহুজনের সমাগম দেখে আমাদের সেই পুরানো যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। আত্মীয় বন্ধুরা যাতায়াত করলে তো কথাই নেই, সামান্যতম পরিচয় আছে বা শুধু মুখ চিনি, এমন কোন মেয়ের যাতায়াতের খবর পেলেও আমরা ভাগলপুর স্টেশনে ছুটে এসেছি। অসুবিধা থাকলেও কোনো না কোনো বন্ধু জোর করে টেনে এনেছে।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।