এই পর্যন্তই মাটির সীমানা । মাটি ফারলো তো শুরু হল জল। যতদূরে তাকান যায়—কালো নোনা অফ রন্ত জল, অশান্ত গর্জন আর পাহাড়-প্রমাণ ঢেউ। এর নাম সমূদ্র। মানচিত্রে বঙ্গোপসাগর নামে এর পরিচয়। মাটির দখল থেকে সমুদ্র পৃথিবীকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এ জায়গাটা বাঙলা দেশের দক্ষিণ সীমান্ত। সামনে নোনা জল কিন্তু এর মাটি বড় সরস, বড় মিঠে । নোনা জলের পারের মিঠে মাটিতে মাথা তুলে আছে গরান, গর্জন, বাণী, তরা—হাজার জাতের গাছ। আছে বনতুলসী, জলভেঙয়া, মাথিয়া আর মিয়া লতার ঝোপ। বেটে বেটে কদাকার চেহারার গেমো বন। সব মিলিয়ে জটিল এক অরণ্য। এই অরণ্যের বয়স যে কত, লেখাজোখা নেই ৷ গেমো বনের ভেতর শঙ্খিনী সাপেরা পেট টেনে টেনে চলে। বাঘের চোখে ফসফরাস জ্বলে। কুমীরের পাল পারের মাটিতে চোখ বুজে রোদ পোহায়। শীতের মরসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে সুরগুলো পাখিরা আসে। বছরের সব ঋতুতে এখানকার আকাশে বগারি পাখিরা ওড়ে। সী-গাল, গোয়েলেথ এবং নানা “জাতের সাগর পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয় ৷ এ জায়গাটার নাম নেই। পৃথিবীর মধ্যে থেকেও এ জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে। একালে থেকেও প্রাগৈতিহাসিক, বর্বর। এ জায়গাটা এ কালের কিছুই পায় নি। না সভ্যতা, না রুচি, না কিছ, পাবেই বা কেমন করে ? কস্মিনকালে কি এখানে মানুষ এসেছে । উত্তর থেকে একটা গেরুয়া নদী দক্ষিণের এই সমুদ্রে এসে মিশেছে। নদীর পার ধরে ধরে একদল মানুষ একদিন এখানে এসে হানা দিল। বিচিত্র একদল মানুষ তারা আধা যাযাবর, আধা গৃহী। গেমো বনের পাশে বিরাট এক শিশু গাছের ছায়ায় তারা আস্তানা গাড়ল । তাদের লটবহরের ভেতর থেকে দা বের,ল, কুড়োল বেরল। দা আর কুড়োলের মুখে মুখে অরণ্য মাথা নোয়াল, মিঠে মাটি মুখে তুলল। সমস্ত রাত তাদের আস্তানায় আগুন জ্বলে আর ডিমডিম শব্দে ঢোলক বাজে।
তিনি অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামে ১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন, স্বাধীনতার পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে চলে আসেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পূর্ব পার্বতী' (১৯৫৭)। উপন্যাস রচনার জন্য তিনি সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। 'সিন্ধুপারের পাখি'র জন্য ১৯৫৮ তে পেয়েছেন পুরস্কার, 'ক্রান্তিকাল' এর জন্য ২০০৩ এ অকাদেমি পুরস্কার। প্রফুল্ল রায় এর উদ্বাস্তু জীবনকেন্দ্রিক যে সমস্ত উপন্যাসগুলি রচিত সেগুলি হল ‘কেয়াপাতার নৌকা’ (২০০৩), ‘শতধারায় বয়ে যায়’ (২০০৮), ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ (২০১৪), ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ (বাং ১৩৬৬)। ‘কেয়াপাতার নৌকা’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ আকারে এবং নামে আলাদা হলেও আসলে তিনটি উপন্যাস মিলেই একটি উপন্যাস, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র পরবর্তী খণ্ড ‘শতধারায় বয়ে যায়’ এবং তারও পরবর্তী খণ্ড ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। তিনটি উপন্যাসই আকারে মহাকাব্যিক। অসামান্য ক্ষমতা সম্পন্ন এইঔপন্যাসিক সারা জীবন জুড়ে পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। 'সিন্ধু পারের পাখি'র জন্য ১৯৮৫ তে 'বঙ্কিম পুরস্কার', 'ক্রান্তিকাল' উপন্যাসের জন্য ২০০৩ এ পেয়েছেন 'সাহিত্য অকাদেমি' পুরস্কার, এছাড়াও 'রামকুমার ভুয়ালকা', পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট', 'শরৎস্মৃতি', 'বি কে জে এ' ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার গল্প উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে ৪৫টির মতো টেলিফিল্ম, টেলি-ধারাবাহিক, ফিচার-ফিল্ম। 'মোহনার দিকে' অবলম্বনে 'মোহনার দিকে' (১৯৮৪), 'আদমি আউ আউরত' (১৯৮৪), 'একান্ত আপন'(১৯৮৭), 'চরাচর'(১৯৯৪), 'টার্গেট' (১৯৯৭),'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০৩), 'ক্রান্তিকাল'(২০০৫) ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান 'Best ASEAN film Award', 'Netpac Award', ও 'Golden Lotus Award'পায়। 'ক্রান্তিকাল' পায় 'Indian compitional Special Mention' পুরস্কার।