ভূমিকা ছেচল্লিশে অখণ্ড ভারতবর্ষ জুড়ে যে দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল তার মর্মান্তিক স্মৃতি এখনও আমাকে দুঃস্বপ্নের মতো নিয়ত তাড়া করে। সেদিনের সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে নিহত হয়েছিল কয়েক লক্ষ মানুষ, বিনষ্ট হয়েছিল বিপুল সম্পদ। আসমুদ্র হিমাচল বহুকালের সহিষ্ণু এই দেশে রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। তার চেয়েও বড় ক্ষতি যা হয়েছিল তা এইরকম। দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে আবহমান কালের সম্প্রীতি একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। পারস্পরিক বিদ্বেষ, অবিশ্বাস আর ঘৃণায় সমস্ত বাতাবরণ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ছেচল্লিশের সেই দাঙ্গার এক বছরের মধ্যে দেশ দু টুকরো হয়ে সৃষ্টি হল পাকিস্তানের! তারও চব্বিশ বছর পর পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ ঘটে, জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। গত আধখানা শতাব্দী ধরে আমাদের এই উপমহাদেশের ওপর দিয়ে চমকপ্রদ এবং রক্তক্ষয়ী ঘটনাপ্রবাহ বয়ে চলেছে। আমরা ইতিহাসের এক ভয়াবহ সময়ের সাক্ষী। সেই যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তার বিষক্রিয়া এখনও চলছেই। আমরা সর্বক্ষণ যেন একটা বারুদের স্তূপের মাথায় বসে আছি। নানা ছুতোনাতায়, কারণে অকারণে যে কোনো মুহূর্তে হানাহানি ঘটে চলেছে। আরো কতকাল যে এর জের চলবে, কেউ জানে না। এ বছর ছেচল্লিশের দাঙ্গার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমার পাঠকেরা জানেন দাঙ্গা এবং দেশভাগের পটভূমিতে বেশ কিছু গল্প আমি লিখেছি। এই উপলক্ষে আমার সেই সব গল্প থেকে বারটি গল্প বেছে নিয়ে এখানে প্রকাশ করা হল। আশা করি একত্রে গল্পগুলি পেয়ে পাঠকেরা খুশি হবেন এবং পঞ্চাশ বছরের দাঙ্গার নানা চিত্র তাঁদের সামনে ফুটে উঠবে। এই সংকলনে ‘একটি শব্দের মানে' গল্পটি কিঞ্চিৎ দলছুট। সরাসরি দাঙ্গা বা দেশভাগ এখানে উপস্থিত নেই। তবে পরোক্ষভাবে তার প্রচণ্ড ধাক্কা এসে পড়েছে গল্পটির প্রধান চরিত্র জয়তীর ওপর। সে দিক থেকে গল্পটি প্রাসঙ্গিক ।
তিনি অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামে ১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন, স্বাধীনতার পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে চলে আসেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পূর্ব পার্বতী' (১৯৫৭)। উপন্যাস রচনার জন্য তিনি সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। 'সিন্ধুপারের পাখি'র জন্য ১৯৫৮ তে পেয়েছেন পুরস্কার, 'ক্রান্তিকাল' এর জন্য ২০০৩ এ অকাদেমি পুরস্কার। প্রফুল্ল রায় এর উদ্বাস্তু জীবনকেন্দ্রিক যে সমস্ত উপন্যাসগুলি রচিত সেগুলি হল ‘কেয়াপাতার নৌকা’ (২০০৩), ‘শতধারায় বয়ে যায়’ (২০০৮), ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ (২০১৪), ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ (বাং ১৩৬৬)। ‘কেয়াপাতার নৌকা’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ আকারে এবং নামে আলাদা হলেও আসলে তিনটি উপন্যাস মিলেই একটি উপন্যাস, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র পরবর্তী খণ্ড ‘শতধারায় বয়ে যায়’ এবং তারও পরবর্তী খণ্ড ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। তিনটি উপন্যাসই আকারে মহাকাব্যিক। অসামান্য ক্ষমতা সম্পন্ন এইঔপন্যাসিক সারা জীবন জুড়ে পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। 'সিন্ধু পারের পাখি'র জন্য ১৯৮৫ তে 'বঙ্কিম পুরস্কার', 'ক্রান্তিকাল' উপন্যাসের জন্য ২০০৩ এ পেয়েছেন 'সাহিত্য অকাদেমি' পুরস্কার, এছাড়াও 'রামকুমার ভুয়ালকা', পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট', 'শরৎস্মৃতি', 'বি কে জে এ' ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার গল্প উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে ৪৫টির মতো টেলিফিল্ম, টেলি-ধারাবাহিক, ফিচার-ফিল্ম। 'মোহনার দিকে' অবলম্বনে 'মোহনার দিকে' (১৯৮৪), 'আদমি আউ আউরত' (১৯৮৪), 'একান্ত আপন'(১৯৮৭), 'চরাচর'(১৯৯৪), 'টার্গেট' (১৯৯৭),'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০৩), 'ক্রান্তিকাল'(২০০৫) ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান 'Best ASEAN film Award', 'Netpac Award', ও 'Golden Lotus Award'পায়। 'ক্রান্তিকাল' পায় 'Indian compitional Special Mention' পুরস্কার।