হঠাৎ চলন্ত জীপ থেকে ছিটকে পড়ে যেতে-যেতে বাঁচবার আশায় আকুল আগ্রহে হাত বাড়ালেন পূর্ণলক্ষ্মী। একটি অট প্রার্থনায় নড়ে উঠলাে ঠোট, কী বললেন, কাকে বললেন, কিছুই বােঝা গেলাে না ; কেবল গাড়িটা বিদ্যুৎগতিতে বোঁ-বোঁ করে ধুলাের ঝড় তুলে চক্ষের পলকে কোথায় উধাও হয়ে গেলাে। তিনি চঁাচাতে চেষ্টা করলেন, আওয়াজ বেরুলাে না গলা দিয়ে, অশেষ যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে করে করে ফেলতে চাইলেন শরীরটা। এক ফোঁটা নড়লাে ন, চোখ খুলে আর একবার, আরাে একবার শেষবারের মতাে দেখতে চাইলেন পৃথিবীটাকে চোখের পাতা নিশ্চল হয়ে রইলাে। তারি মধ্যে ইতিহাস হয়ে যাওয়া জীবনটাকে আবার দপ করে চোখের তলায় ফুটে উঠতে দেখলেন। স্বপ্ন। শুধু স্বপ্ন। সারাজীবনের স্বপ্ন। স্বামী সন্তানের স্বপ্ন, ভরা সংসারের স্বপ্ন। কেমন করে শুন্য কলসী ধীরে-ধীরে একদিন পূর্ণ হয়ে উঠেছিলাে, আর কেমন করে সেই কলসীর জল একেবারে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলাে তার স্বপ্ন। ছায়াছবির মতাে একের পর একটি দৃশ্য পরিষ্কার স্পষ্ট চেহারা নিয়ে ফুটে উঠতে লাগলাে তাঁর চিরকালের জন্য বুজে-আসা চোখের তলায়। স্মরণশক্তির সুতীব্র আঘাতে বুকের পাঁজরগুলাে খ’সে যেতে লাগলাে। দুরন্ত রােদুরের তাপে পুড়তে-পুড়তে আটষট্টি বছর আগে যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেদিনটাকে প্রত্যক্ষ করলেন মৃত্যুর অতল অন্ধকারে তলিয়ে যেতে-যেতে। দেখলেন সেই থমথমে সন্ধ্যা, সঁতসেঁতে আঁতুড় ঘর, আর কতকগুলি হতাশ মুখের ফ্যাকাশে রঙ। একটা শেয়াল দৌড়ে গেলাে, ভাঙা আঁতুড় ঘরের বেড়ার ফাঁকে হাওয়া ব’য়ে গেলাে শিরশির করে, মা নবজাত সন্তানের মুখ দেখে কেঁদে উঠলেন।
জন্ম ১৩ মার্চ, ১৯১৫ । তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। প্রতিভা বসু অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের) ঢাকা শহরের অদূরে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম আশুতোষ সোম ও মায়ের নাম সরযূবালা সোম। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহের আগে তিনি রাণু সোম নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত ও দময়ন্তী বসু সিং এবং এক ছেলে শুদ্ধশীল বসু। শুদ্ধশীল বসু মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান। প্রতিভা বসুর দৌহিত্রী কঙ্কাবতী দত্তও একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। প্রতিভা বসু পশুপ্রেমী ছিলেন। প্রতিভা বসু'র অধিকাংশ বই বাণিজ্যিকভাবে সফলতার মুখ দেখে। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়ণ হয় ও ব্যাপক সফলতা পায়। গান করার পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন। প্রতিভা বসু'র জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে বই বিক্রেতা এবং প্রকাশকদের মধ্যে বই প্রকাশ ও বিতরণ নিয়ে ঝগড়ারও ঘটনা ঘটে। বাংলা ভাষায় অনন্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও, সাহিত্যকর্মে সবিশেষ অবদানের জন্য আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর, ২০০৬সালে।