দু’দিন বেশ ভুগে উঠলেন সন্দীপ সেন। ফ্লু হয়েছিলাে। কাঁচা সর্দির বেগে নাকে-মুখে পথ দেখতে পাচ্ছিলেন না। এই ঘন ঘন সর্দি-রােগ তার আবাল্যের। কতাে লােককে কতাে ওষুধ দেন, অথচ নিজের এই সর্দির সঙ্গে যুদ্ধ করে অদ্যাবধি তিনি পরাজিত। আজ ভালাে আছেন। পুরাে একটা দিন অনশনে কাটিয়ে শরীরটা হালকা লাগছে। ঝরঝরে মনে হচ্ছে। খিদেও পেয়েছে।ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করে নিলেন। ধােপদুরস্ত জামা-কাপড় পরে প্রসন্নচিত্ত হলেন। বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে উদার অপার আকাশের গভীর নীলে তাকিয়ে মনটা তৃপ্তিতে ভরে গেল।না-ভরার কারণ নেই। যা বৃষ্টি ক দিন। এই শুকনাে দেশে বৃষ্টি অবশ্য ভালােই । লাগে। কতােবার তাে পর্জন্যদেবের দয়ার জন্য কতাে প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু এবারকার ছিচকে বৃষ্টি জ্বালিয়ে খেয়েছে। প্রায় হপ্তা দুই তাে চললাে। মাঝে মাঝে পশলা-বৃষ্টিও হয়েছে, গাছ-পাতা ধুয়ে-মুছে ফিটফাট। ভালাে লেগেছে রাত্তিরে ঘুমের সময়ে। তা বলে পনেরাে দিন ধরে চলবে? মানুষের কি কাজ-কর্ম নেই? বৃষ্টির কৃপায় এই ক্যাম্পাসে তাকে নিয়ে অন্তত জনাপাঁচেক জ্বরের কবলীকৃত হয়েছে। বাগান-রক্ষক নিতাইবাবু বলতে গেলে এখনাে বেশ দুর্বল। জ্বর যথেষ্ট উঁচু ছিলাে। রক্ত পরীক্ষা না করেও তিনি বুঝেছেন ওটা এন্টারিক ফিভার। যাক, মানে মানে যে চট করে ওষুধটা ধরে গেল সেটাই রক্ষে। ইসকুলের শিক্ষয়িত্রীদের মধ্যেও দুজন ভুগলেন। ওঃ হাে৷ ইসকুলের কথা ভাবতেই সন্দীপ সেনের মুখে এই শব্দটি সরবে উচ্চারিত হলাে। একটা জরুরি কথা মনে পড়ে গেল তক্ষুনি। তক্ষুনি আকাশের নীল শােভা থেকে। চোখ সরিয়ে, ধূ ধূ মাঠের চিকচিকে কাপা-কাঁপা রােদের মরীচিকা ভেদ করে অদূরে অবস্থিত বালিকাবিদ্যালয়টির দিকে তাকালেন। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে আজ ইসকুলটিকে। সামনে টানা লম্বা বারান্দা, বারান্দার সামনে ছােটো ছােটো ভূখণ্ডে কতাে ফুল। নিতাইবাবুর কতিত্ব আছে। এই সম্ভার তাঁরই দান। তার বুদ্ধি-বিদ্যাতেই এই পাথুরে মাটিতে এমন রঙের ফোয়ারা। মাঝখানে কেমন সবুজ লন পিছনে মেয়েদের খেলার মাঠ। ওপাশে আবার সজিখেত। দূরে দূরে ছবির মতাে শিক্ষয়িত্রীদের কুটির। সব কুটিরের সামনেই একুট ঘেরা বাগান, ছােট্ট গেট, চৌখুপি বারান্দা। প্ল্যানটা কিন্তু বেশ ভালাে হয়েছে। ভালােই করেছি। নিজেকে খুশির সঙ্গে তারিফ করলেন। অবশ্য এখনােসম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু হবে। ইসকুল যে তালে বেড়ে উঠছে। তাতে সব হবে। মেয়েদের থাকবার বাড়িটা আরাে বাড়ানাে দরকার, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর গৃহটি আর-একটু বড়াে হওয়া দরকার। মালি-মেথর-ভৃত্য ইত্যাদির আবাসস্থল আরাে আরামদায়ক হওয়া উচিত।
জন্ম ১৩ মার্চ, ১৯১৫ । তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। প্রতিভা বসু অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের) ঢাকা শহরের অদূরে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম আশুতোষ সোম ও মায়ের নাম সরযূবালা সোম। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহের আগে তিনি রাণু সোম নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত ও দময়ন্তী বসু সিং এবং এক ছেলে শুদ্ধশীল বসু। শুদ্ধশীল বসু মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান। প্রতিভা বসুর দৌহিত্রী কঙ্কাবতী দত্তও একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। প্রতিভা বসু পশুপ্রেমী ছিলেন। প্রতিভা বসু'র অধিকাংশ বই বাণিজ্যিকভাবে সফলতার মুখ দেখে। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়ণ হয় ও ব্যাপক সফলতা পায়। গান করার পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন। প্রতিভা বসু'র জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে বই বিক্রেতা এবং প্রকাশকদের মধ্যে বই প্রকাশ ও বিতরণ নিয়ে ঝগড়ারও ঘটনা ঘটে। বাংলা ভাষায় অনন্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও, সাহিত্যকর্মে সবিশেষ অবদানের জন্য আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর, ২০০৬সালে।