"বনী" বইটিতে লেখা উপন্যাসের কিছু অংশ: বসন্তবনে ইটখোরি-পিতিজ, হাজারিবাগ ‘পথিক পরাণ, চল, চল, চল সে পথে তুই যে পথ দিয়ে গেল রে তোর সকালবেলার জুই। যে পথ বেয়ে গেছে যে তোর সন্ধ্যা মেঘের সোনা, প্রাণের ছায়াবীথির তলে গানের আনাগোনা রইল না কিছুই। যে পথে তোর পাপড়ি দিয়ে বিছিয়ে গেল ভুই পথিক পরাণ, চল, চল, সে পথে তুই অন্ধকারে সন্ধ্যায়ূথীর স্বপনময়ী ছায়া। উঠবে ফুটে তারার মতো কায়াবিহীন মায়া ছুঁই তারে না ছুঁই। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমাদের কী যে হতো! বেশ গরম ছিল কাল রাতে। প্রথম রাতে ঘুম হয়নি। শেষ রাতে যখন ঘুম এল তখন দুটি পিউ কাহা আর একটি পাগলা কোকিল শুক্লপক্ষের চাদভাসি বনে এমনই চিৎকৃত পাগলামি করতে লাগল যে ঘুমোয় কার সাধ্যি। তাছাড়া, বসন্ত বনে এসে রাতে ঘুমোয় নিতান্ত বেরসিকেরাই। এই যে গরম পড়েছে হঠাৎ, তার মানেই হচ্ছে এই যে আজ-কালের মধ্যে বৃষ্টি হবে। এই বৃষ্টি হচ্ছে গ্রীষ্মের পাইলট-কার। এরই পেছন পেছন বসন্তের বিচিত্রবর্ণ ঝর-ফুল আর ঝরা-পাতার গালচের ওপর দিয়ে তার অগণ্য জ্বালামুখী অশ্বারোহী ঘোড়ার মিছিল করে গ্রীষ্ম আসবে তার দাবদাহ নিয়ে। তবে বনকে সব ঋতুতেই সুন্দর দেখি আমি। বিভিন্ন ঋতুতে তার রূপ বিভিন্ন। সুন্দরী কোনও মেয়েকে প্রতিদিন একই পোশাকে কারই বা ভাল লাগে! ক্ষণে ক্ষণে সে বাস বদলাবে, বেশ বদলাবে, একবার এলো-খোঁপা অন্যবার দু-বেণী, আবার শ্রাবণের মেঘের মতো সুগন্ধি খোলা চুল, কখনও বা……
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।