লেখকের কথা ছেলেবেলা থেকেই দেশের মধ্যে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি। বেড়ানোই আমার অন্যতম প্রধান আনন্দ ছিল এবং আছে। যতটুকু সাহিত্যকর্ম করি তার পটভূমি এমনই বিচিত্র ও ব্যাপ্ত যে পাঠকসাধারণের একটি বড় অংশ আমাকে ভ্রমণ-সাহিত্যিক আখ্যা দিয়ে থাকেন। তাতে আমার কোনো দুঃখ অবশ্য নেই। বাংলা সাহিত্যর একটি প্রধান অংশই ত কলকাতার এঁদো-গলি বা বস্তীতে ও করপোরেশনের পার্কের বেঞ্চে বসা প্রেমেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই সাহিত্যের দিগন্ত যদি ছড়িয়ে দিতে পেরে থাকি তবে সেত আনন্দেরই কথা। প্রথমবার ইয়োরোপে যাই সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে। আমাদের আগের প্রজন্মের বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সাহেবদের চাকর। তাই লানডানের জুতোর দোকানে যখন সাহেব আমার পা ধরে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করতে করতে জুতো পরিয়ে দিয়েছিল তখন বড় আনন্দ হয়েছিল। সেই সব তাৎক্ষণিক অনুভূতি দিয়েই সাজিয়ে তুলেছি ‘প্রথম প্রবাস'-এর ডালি। কোনো ভাণ ভণ্ডামি করিনি, কোনো মিথ্যা কথাও বলিনি। পাঠকদের যদি রসবোধ থাকে তাহলে প্রথম প্রবাস তাঁদের অবশ্যই ভাল লাগবে। ইয়োরোপের পর সেই বারই কানাডাতে গেছিলাম – কানাডায় বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে স্টেটস-এ গেছিলাম। স্টেটস-এর পূর্বপ্রান্তে কিছুদিন থেকে পশ্চিম প্রান্তে গেছিলাম লসএঞ্জেলস এ। হলিউড, ডিজনিল্যান্ড সব সেবারেই দেখি। সেখান থেকে হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ওয়াইকিকিতে ছিলাম বেশ ক’দিন। ‘ওয়াইকিকি’ নামের একটি গোয়েন্দা উপন্যাসও আছে আমার ওয়াইকিকির পটভূমিতে। ওয়াইকিকি থেকে গেছিলাম প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে জাপানে। টোকিও, ওসাকা, কোবে ইত্যাদি জায়গাতে। ছিলাম পনেরোদিন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে কলকাতা ফিরি। উনিশশ উনসত্তরে আফ্রিকাতে যাই—স্যেসেলস আইল্যান্ডস হয়ে। ডার-এস-সালাম-এ নেমে সেখানে দিনকয় থেকে আরুশাতে যাই। আরুশা থেকে লেক মানীয়ারা এবং পৃথিবীর বৃহত্তম মৃত আগ্নেয়গিরি গোরোংগোরো'র লজ-এ রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে গোরোংগোরোর গহ্বরের ন্যাশানাল পার্ক-এ ঘুরে সেদিনই ব্রেকফাস্ট করে এসে পৌঁছই সেরেঙ্গেটি প্লেইনস এ। ‘পঞ্চম প্রবাস’ সেই সব আফ্রিকান অভিজ্ঞতার কাহিনী। এতে কিঞ্চিৎ কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি একটি জার্মান মেয়ের ব্যাপারে। বুদ্ধিমান পাঠক হয়ত ধরে ফেললেও ফেলতে পারেন । পুব-আফ্রিকার মাসাই উপজাতিরা আমার বহুদিনের বিস্ময়। সেই প্রথম তাদের কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। গোরোংগোরোতে, ওভাই গর্জ-এর কাছে, যেখানে প্রথম মানুষের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল, মাসাইদের সঙ্গে মিশে দেখার সুযোগ হয়েছিল। থাকা হয়েছিল তাদের “ক্রাল”-এ। এখনও মাসাই মেয়েরা তেমন মাসাই পুরুষকে বিয়েই করে না যে নিজে পায়ে হেঁটে সিংহ না মেরেছে। এমন উপজাতি সম্বন্ধে উৎসাহ থাকাটা ত স্বাভাবিক । দেশে ফেরার সময় মাসাইদের সম্বন্ধে লেখা অনেক বই নিয়ে এসেছিলাম। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পড়াশুনো দুইয়েরই ফসল ‘ইলমোরাণদের দেশে”। “ইলমোরাণ” বলে মাসাই যোদ্ধাদের।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।