কি গো অর্পণ? বুঝছটা কি? কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে মুখ বের করে ট্রেনটা কেন দাঁড়িয়ে আছে তা দেখার নিষ্ফল চেষ্টা করে বললাম, কিছুই তো বুঝছি না গামাদা। বর্ধমান হাওড়া লোকালের এই নিত্যযাত্রীদের মধ্যে তরুণতর অনেকেই আছে যারা উঁচু ই. এম. উ. কোচ-এর সিঁড়ি থেকেও জমিতে ফটাফট নিচে নেমে গার্ড অথবা এঞ্জিনম্যান-এর কাছ থেকে ট্রেনের খাল-খরিয়ৎ পুছ-পাছ করে ফিরে এসে আমাদের মতন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের তরতাজা খবর জানায়। অপু আর মদন গেছিল, মুড়িওয়ালা জীবন, তরমুজওয়ালা ঘন্টেশ্বরের সঙ্গে। তারা সকালেই আগে পরে ফিরে এসে বলল, আগের গাড়ি মোষ মেরেছে সামনের লেভেল ক্রসিং-এ। সেই মোষ, লাইনের ওপর থেকে যতক্ষণ সরানো না হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের লোকাল কখন যাবে তার কোনই ঠিক নেই। গামাদা, ওরফে যতীনবাবু পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে তাঁর জামাই-এর উপহার দেওয়া নতুন টাইমেক্স ভিসটা ঘড়িটার সঙ্গে শুভদৃষ্টি করে বললেন, হল্লো। আপিসে আজও লেট। নতুন এক কুলোপানা চক্কর ডি সি এয়েচে। লাইপ হেল করে দিলে র্যা। তার মুখটা মনে করলেই আমার... দুসস...। যতীনবাবুর কোলের ওপরেই 'সংবাদ প্রতিদিন' কাগজটা মাঝখান দিয়ে ভাঁজ করা অবস্থাতে রাখা ছিল। আমি 'বঙ্গলোক' পড়ি। নতুন কাগজ কিন্তু ভালো কাগজ। অন্য কাগজ একটু-আধটু দেখি, চোখ বুলিয়ে।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।