"দশম প্রবাস" বইটিতে লেখকের কথা: উনশশো চুয়াত্তরে গিয়েছিলাম ইংল্যান্ড ও ইয়ারোপে। সেই প্রথম অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলাম প্রথম প্রবাস’ তারপর জাপান, উত্তর আমেরিকা এবং কানাডাতে গিয়েছি। উনিশশো উনআশিতে গিয়েছি সেস্যেলস আইল্যান্ড এবং পুব আফ্রিকাতে। পুব আফ্রিকার ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছিলাম ‘পঞ্চম প্রবাস’-এ সেস্যেলস্ নিয়ে ‘ঋজুদার সঙ্গে সেস্যেলস্-এ ছাড়া অন্য কিছু লিখিনি। তারপর একাধিকবার জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, লানডান এবং ব্যাংককে গিয়েছি। উনিশশো একানব্বই-এর বঙ্গ সম্মেলনে গিয়েছিলাম বস্টনে। সেখান থেকে এসেছিলাম কানাডার টরন্টোতে। সেইসব প্রবাসের দিন নিয়ে কিছু লেখার সময় করে উঠতে পারিনি। ২০০৩-এ আটলান্টার বঙ্গ সম্মেলন এবং কানসাস সিটির বঙ্গ মেলাতে যাওয়ার সুবাদে এবং ছোটকন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ-এর অভিপ্রায়ে মনট্রিয়াল, কিবেক সিটি, টরন্টো এবং বস্টনে খুব বেড়ানো হয়েছে। ভারমন্ট-এর গ্রিন মাউন্টেন্স প্রভিন্সিয়াল পার্ক, নিউ হ্যাম্পশায়ারের হোয়াইট মাউন্টেন্স প্রভিন্সিয়াল পার্ক, অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালা দেখা হয়েছে। সেখানে একটু পরপরই Moose Crossing! উত্তর আমেরিকার এই অতিকায় হরিণেরা আমাদের শম্বরদের সমগোত্রীয়। অতলান্তিক সমুদ্রে তিমি মাছ দেখা, হেনরি ডেভিড থোরোর The Walden—হ্রদ দেখা, উত্তর অনটারিওর অ্যালগনকুইন প্রভিন্সিয়াল পার্ক, নায়াগ্রা প্রপাত নতুন করে দেখা। নায়াগ্রা অন লেক-এর পিচ ফেস্টিভ্যাল দেখা, মনট্রিয়ালের বিখ্যাত জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল দেখা ও শােনা সবই হয়েছে। এতসব জায়গাতে যাওয়া হল বলেই ভাবলাম ডায়েরির মতো পাঠক পাঠিকাদের ভাললাগার মতো কিছু কথা বলা যাবে, তাই কলম ধরি। দশম প্রবাস’-এর এই অনুপ্রেরণা তবে এ লেখা বড়ই ব্যক্তিগত। এবারে আটলান্টার বঙ্গ সম্মেলনে যাননি এমন মানুষ কলকাতায় হয়ত খুব কমই ছিলেন। কানসাস সিটিতেও অত না হলেও বেশ কিছু মানুষ গিয়েছিলেন কলকাতা থেকে। আমি যখন স্টেটস থেকে কানাডাতে ফিরলাম তখন সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র এবং বিভাস চক্রবর্তী মজুত। আমি যেতে, নরক একেবারে গুলজার। এইসব অভিজ্ঞতা এবং মোলাকাত-এর কথা জানতে শুনতে হয়ত পাঠকপাঠিকার খারাপ লাগবে না এই ভেবেই এই প্রয়াস। সমাদৃত হলে খুশি হব। বুদ্ধদেব গুহ কলকাতা, ১লা অক্টোবর, ২০০৩
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।