আশাপূর্ণা দেবী কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়। বাঙালি জীবনেও এক বিস্ময়। কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়েও এই মহীয়সী নারী নিতান্ত ঘরোয়া ও আটপৌরে সংসারের মধ্যে থেকেই রচনা করেছেন একের পর এক অবিস্মরণীয় সাহিত্য। শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্য তিনি জয় করেছেন আপন আত্মশক্তিতেই। নারীচরিত্র সৃজনের অসামান্য দক্ষতাই শুধু নয়, যে-কোনও মহান স্রষ্টার মতোই তিনি চিনতেন মানুষের অন্তরমহল। তার আশ্চর্য অনুভব— “মানুষের যতটুকু দেখি সেটুকুই তার সব নয়, যেটা দেখি না সেটাও অনেকখানি।” এই ‘না-দেখা টুকুতেই যে আলো ফেলতে হয় সাহিত্যস্রষ্টাকে, তা জানতেন বলেই আশাপূর্ণা কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক। নারী ও পুরুষ মিলিয়েই যে-মানুষ, তাই ছিল তাঁর আরাধ্য। সামগ্রিকভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেরা মধ্যবিত্ত বাঙালি। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের নানা মূল্যবোধ, যেগুলি বহু ভাঙনেও এখনও বহমান, আশাপূর্ণার সাহিত্যে সেগুলিই চিরস্থায়িত্ব লাভ করেছে। তার বিপুল স্বর্ণভাণ্ডার থেকে চয়ন করে পূর্বেই আনন্দ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দশটি উপন্যাস', যা পাঠক সমাদৃত। এবার প্রকাশ করা হল 'দশটি উপন্যাস'-এর আরও একটি যণ্ড। এই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে— পুতুলের গল্প, বিজয়িনী, পরিচয়ের শেষকথা, শব সাধক, দায়বদ্ধ, এক আত্মঘাতের প্রেক্ষাপটে, পুরনো কলকাতার একটি অন্তঃপুরের কাহিনী, মুহূর্তের কারসাজি, জানা-অজানা এবং তমোনাশের ভ্রমনাশ। অমূল্য এই উপন্যাসগুলি এ-যাবৎ গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত।
Ashapurna Debi (৮ই জানুয়ারি, ১৯০৯ – ১৩ই জুলাই, ১৯৯৫) বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। ১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাঁকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকার আসন। তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তাঁর একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপে ভূষিত করেন। ১৯৯৫ সালে ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।