“আমার উপস্থাপক জীবন" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ আখতারুজামান ইলিয়াস তাঁকে বলেছিল হাজার দেড়েক পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখতে, কারণ ইলিয়াস তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন জীবনকে বিশদভাবে তুলে ধরার ঝোক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন উপন্যাস নয়, কয়েক খণ্ডে আত্মজীবনী লিখবেন, যা কেবল তার নিজের জীবনের গল্প হবে না। হবে তার যুগেরও গল্প। ইলিয়াসকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখে চলেছেন তাঁর জীবনের নানা পর্ব নিয়ে কয়েকটা। গ্রন্থ, আমার উপস্থাপক জীবন তারই একটা অংশ। বইয়ের নাম শুনলে মনে হবে টেলিভিশনের এককালের প্রবল জনপ্রিয় তুখাের অপ্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থাপক তার এ সংক্রান্ত স্মৃতিগুলােই কেবল তর্পণ করবেন, কিন্তু বইটি হাতে নেওয়া মাত্রই পাঠকের সামনে খুলে যাবে অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্য, আনন্দ, তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতির দরজা, সত্যিই এই স্মৃতি কেবল একজন টেলিভিশন উপস্থাপকের নিজের কথা নয়, বরং এ হলাে তার সময়ের কথা, এই বই দেশের চারটি দশকের সাংস্কৃতিক জগতের হৃদয়গ্রাহ্য ইতিহাস। ইতিহাস, কিন্তু তা নীরস নয়। উপন্যাসের চেয়েও রসঘন, রম্যরচনার চেয়েও সুরম্য, এই বইয়ের এমনি প্রসাদগুণ যে একবার হাতে নিলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল। তার মঞ্চে প্রথম ওঠার। শৈশবস্মৃতি দিয়ে এই বই শুরু, বা তারও আগে তাঁর প্রথম কথা বলতে পারা না পারার প্রসঙ্গ দিয়ে, তারপর এদেশে রেডিও ও টেলিভিশন প্রবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে এগুতে থাকে এই স্মৃতিচারণ, চরিত্র হিসাবে উপস্থিত হন প্রখ্যাতঅখ্যাত কত উপস্থাপক, সঙ্গীতশিল্পী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নাট্যব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক-সাংবাদিক। টেলিভিশন উপস্থাপক হিসাবে তার পথচলা, একেকটা সময়ে এককেটা টেলিভিশন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, তারপর অনুষ্ঠানগুলােকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া। যেন একেকটা রােমহর্ষক গল্প। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই স্মৃতিচারণ গ্রন্থমালা বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতি ইতিহাসে এক অনন্য ও স্থায়ী সম্পদ হিসাবে থেকে যাবে। বলেই আমাদের বিশ্বাস।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।