প্রিয় পাঠক, চলুন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভ্রমণসঙ্গী হই, তার সঙ্গে উড়াল দিই, চলে যাই বিলাতে-ওই তাে আমাদের চোখের সামনে বাকিংহাম প্যালেস কিংবা টেমস নদী কিংবা অক্সফোর্ড। অথবা আমরা এখন যাত্রী পাতালরেলের। সব কিছু জীবন্ত আর বাস্তব, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ভবন, প্রতিটা বাগান আর প্রতিটা চরিত্র। কিন্তু শুধু নিজের চোখে দেখার চেয়ে এই দেখা আরও মূল্যবান, অনেক বেশি প্রাণবন্ত, অনেক বেশি আনন্দময়-কারণ কেবল চোখের দেখা তাে নয় এই দেখা- সঙ্গে পাচ্ছি ইতিহাসের প্রেক্ষাপট, পাচ্ছি। তুলনা-প্রতিতুলনা, পাচ্ছি গল্পের উত্তেজনা, পাচ্ছি। প্রাণবন্ত সব চরিত্র আর তাদের সংলাপ, নানা রকমের ঘটনা, যা আমাদেরকে কখনও হাসায়, কখনও ভাবায়, কখনও বা মন খারাপ করিয়ে দেয়। পরিব্রাজন চলতে থাকে, আমরা একে একে বিভিন্ন স্থান দেখতে থাকি, কিন্তু মনের ভেতরে ক্রিয়া করতে থাকে নানা প্রশ্ন, কেন লেখকের বাল্যবন্ধু ফারুক আড়াই পাউন্ডের ফিশফিংগারের দাম তাঁর কাছ থেকে আদায় করেই ছাড়লেন, কিংবা কেন শ্বেতাঙ্গিনী বৃদ্ধা লেখকের প্রশ্নের জবাব দিল না? ওড়াউড়ির দিন-২ কেবল ভ্রমণকাহিনী নয়, এ হলাে সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান, শিল্পকলার এক অপূর্ব সমাহার; কিন্তু লেখকের নিপুণতায় এসব হয়ে উঠেছে রম্যগল্পের মতাে উপভােগ্য ও রসময়। বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে প্রসাদগুণময় দীপিত উজ্জ্বল মেধাবী গদ্য ক্রমশ বিরল হয়ে উঠেছে, শুধু স্বাদু ও ঋদ্ধ গদ্যের আদর্শ হিসেবেও এই গ্রন্থকে আমাদের অবশ্যপাঠ্য গণ্য করা যায়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।