ফ্ল্যাপে লিখা কথা ‘বহে জলবতী ধারা’র কিশোর সংস্করণ ‘আমার বোকা শৈশব’ বইটিতে রয়েছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শৈশবের স্মৃতিচারণ- করটিয়া, জামালপুর,পাবনা,বাগেরহাটের নিসর্গ আর সভ্যতায় জড়াজড়ি করা রহস্যময় পৃথিবী সেই সঙ্গে ঢাকা ও কলকাতার নাগরিক জীবনের উত্তেজনা ও কল্লোল ; আর এ সবকিছুর ওপর দিয়ে মুগ্ধতা ছড়েয় রাখা তাঁর ভেতরকার অনিঃশেষ বিস্ময়বোধ।
একটা শিশু বেড়ে উঠেছে তার সময়কাল স্থানে পটভূমিতে, তার চারপাশে আছে নানা চরিত্র ,তাঁর কলেজ শিক্ষক আব্বা, মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকেরা, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি রেনেসাঁসের উত্তরসূরি সংস্কৃতিবান হিন্দু সম্প্রদায় ,নবজাগ্রত মুসলমান,স্কুলের বন্ধু, মা-ভাইবোনের প্রাণবন্ত পারিবারিক জীবন, মায়ের মৃত্যুবেদনা, গ্রামের জীবনে দুঃখকষ্ট, রাজনৈতিক উত্তেজান এমনি অনেক কিছু। একেকবার সে বড় হয়ে হতে চাইছে একেক কিছু, কখনও খেলোয়াড় ,কখনও গুণ্ডা, কখনও কবি, কখনও দার্শনিক, কখনও পিতার মতোই আদর্শবাদী শিক্ষক, কখনো ট্রেনের ড্রাইভার , কখনো চার্টাড একাউন্ট্যান্ট-কোনটা তাঁর নিয়তি জানা নেই। কিন্তু এসবের থেকেও এই বইয়ের যা বড় সম্পদ তা হল জীবন-নদীর তীরে দাঁড়িয়ে এসব কিছুকে তাঁর নিবিষ্টভাবে দেখে যাওয়া শুধু চোখের দেখা নয়, বিশদভাবে দেখা, শিল্পীর চোখ দিয়ে, কবির চোখ দিয়ে, দার্শনিকের চোখ দিয়ে- আর তাকে ব্যাখ্যা করা, বর্ণনা করা।
অসাধারণ তাঁর ভাষাশৈলী, সজীব ও প্রাণবন্ত তাঁর বর্ণনাভঙ্গি, অথচ একই সঙ্গে রসবোধে টইটুম্বুর।
ভূমিকা ছেলেবলার গল্প নিয়ে আমার একটা বই আছে - নাম ‘বহে জলবতী ধারা’ । বইটা আমি যখন লিখি তখন আমার বয়স তেষট্রি বছর। তখন মোটামুটি বৃদ্ধইি আমি। কাজেই ছেলেবেলার গল্প নিয়ে লিখলেও বইটা শুধু একটি শিশুর রচনা হয়নি, হয়েছে একজন বুড়ো ও একজন শিশু -দুজনের মিলিত লেখা। শিশুর জীবনের অসহায়তা , বোকামি, লোভ, উৎসাহ , স্বপ্ন বা দস্যিপনার সঙ্গে সেখানে জড়িয়ে রয়েছে প্রবীন মানুষটির পরিণত চাউনি, যে কেবল গল্পটা বলেই শেষ করতে চায় না, সেই সঙ্গে জীবনের পটভূমিতে তার একটা মনমতো ব্যাখ্যাও দিতে চায়।
বড়দের কাজে এই ব্যাখ্যাগুলো খারাপ লাগে না। এগুলোর মধ্যে দূর অতীতে ফেলে আসা নিজেদের অর্থহীন আর আনন্দময় শৈশবের একটা সন্তোষজনক অর্থও তারা হয়ত খুঁজে পায়। কিন্তু শিশুরা যখন বইটা পড়ে তখন তারা কিন্তু এই ব্যাখ্যার জায়গাগুলো ঠিকমোত বুঝতে পারে না। এগুলো তাদের কাছে অযথা ,অকারণ এবং অনেক সময় দুরূহ ঠেকে। এর কারণ আছে । শৈশব নিয়ে লেখা বইয়ে শিশুরা শৈশবের নির্জলা গল্পটুকুই শুধু শুনতে চায়, এর স্বপ্ন, আনন্দ, কল্পনা আর মজাটুকুই কেবল পেতে চায়। এর উটকো দার্শনিক ভার ওদের অপছন্দ। শিশুা পৃথিবীতে নতুন এসেছ। মানুষের মধ্যে কেবল তারাই অতীতবিহীন। জরা,ক্ষয় বা কষ্টের নিগ্রহ এখনও তাদের হাড় গুঁড়িয়ে দেয়নি। কাজই জীবনের ভারী ভারী অভিজ্ঞতা বা তত্ত্ব ব্যাখ্যা যা তারা শুনতে নারাজ। তারা চায় তরতাজা জীবনের সোজাসাপটা গল্প। চেতনা জগতের উপলব্ধি নয়, ইন্দ্রিয়ের পঞ্চমপ্রদীপ জ্বলা জীবনের রূপগন্ধময় আস্বাদ। এইসব সাতপাঁচ ভেবে বইটি প্রকাশের পরপরই এর একটি কিশোর সংস্করণ বের করার কথা মনে হয়েছিল। এবার সেটা বের করার উদ্যোগ নিয়েছি। এতে মূল বইয়ের সেটুকুই শুধু রাখা হল যেটুকু কিশোর কিশোরীদের আনন্দ দেবে-যার মধ্যে তারা নিজেদের জীবনের বাস্তব সুখদুঃখের গল্প খুঁজে পবে । আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
সূচি * স্বপ্নের অলিন্দে * পালাবদল * নানা পথের হাতছানি * প্রথম সোপান * ওপরের আকাশ * ভিন্ন ভূগোল * চকিত জানালা * পরিশিষ্ট
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।