মানুষের মন বা চেতনায় ধরা পড়ে জগতের মূর্তরূপ। এটি মূর্ত বিষয় বা বস্তু। পরম্ভ মনের আছে অনুসন্ধিৎসু ক্ষমতা। এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় গঠনমূলক বা সৃজনশীল অথবা ধ্বংসমূলক বা বিনাশশীল উপায়ে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে এই সৃজনশীল ক্ষমতার পথে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তথা বিষয়ীর চেতনায় স্থিতি লাভ করে বিষয় বা বস্তুর পরিষ্কার, স্পষ্ট ও যথাযথ ধারণা। এটিই জ্ঞান। জার্মান দার্শনিক এডমন্ড হুসাৰ্ল এই জ্ঞানের যে পথ অনুসন্ধানে প্রবৃত্তহন, দর্শনের ইতিহাসে তা phenomenology বা প্রতিভাসবিজ্ঞান নামে পরিচিত। তিনিই এই দার্শনিক মতাদর্শের প্রবর্তক। হুসাৰ্ল ছিলেন অঙ্কশাস্ত্রের ছাত্র। এর মৌলিক অসঙ্গতিই তাঁকে টেনে নিয়ে আসে দর্শনের আলোচনায়। বিষয় বা বস্তুই প্রাধান্য পায় এই আলোচনায়। এটিই প্রতিভাস। বিষয়ীর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এটি। এই বিষয়ীই তাঁর আলোচনায় অহম। এই অহম-এর কর্মকাণ্ড অগ্রসর হয় অভিজ্ঞতার পথে। বিধায় অভিজ্ঞতাই তাঁর দার্শনিক আলোচনার ভিত্তি। কিন্তু অভিজ্ঞতায় প্রতিভাসের কেবল জাগতিক রূপ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়, যা পরিবর্তনশীল রূপ। তাই প্রতিভাসের যাথার্থ্য জ্ঞান লাভের লক্ষ্যে তিনি অনুসন্ধান করেন এর মৌলিক বা বিশুদ্ধ রূপ। হুসার্লের প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় ছিল মনোবিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার প্রভাব। এটি অভিজ্ঞতা নির্ভর। অভিজ্ঞতার কর্মকাণ্ড অগ্রসর হয় অভীপ্সিত উপায়ে। কিন্তু প্রতিভাসের বিশুদ্ধ স্তরে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া পরিচালনায় এ যথেষ্ট নয়। তাই অভিজ্ঞতার গণ্ডির মধ্যে হুসার্লের এই আলোচনা সীমিত থাকে নি। এমনকি প্রতিভাসের যথাযথ পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে এবং এর স্বজ্ঞামূলক উপলব্ধি লাভের প্রত্যাশায় পারিপার্শ্বিকতা থেকে করা হয় এটিকে বিচ্ছিন্ন। এ পর্যায়ে তাঁর আলোচনায় আসে “ইপোকি” ও “প্রতিভাস বিজ্ঞানসম্মত অবহ্রাস পদ্ধতি"। লক্ষ্য এই জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি অনুসন্ধান করেছেন মৌলিকত্ব, যা সুকঠোর বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী। এটিই বৈজ্ঞানিক দর্শন। তাঁর মতে, সব বৈজ্ঞানিক দর্শনের ভিত্তিই প্রতিভাসবিজ্ঞান। আসলে মানুষের জ্ঞানকে একটি সুদৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠার জন্যেই হুসার্লের এই দার্শনিক প্রয়াস, যার সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটেছে এ গ্রন্থে।